রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) দ্বাদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ক্যাম্পাসেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রথম নেতাকর্মী শহীদ হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। দীর্ঘদিন পর সেই ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসে ‘ঢাকা মেইল’-এর কাছে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতারা। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিই প্রথম সমাবর্তন।
১৯৫৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত মোট ১২ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ১৯৮২ সালে এখানে এক ভয়াবহ সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ১০ মার্চ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে লিফলেট বিতরণ করেন। পরদিন ১১ মার্চ ছিল নবীনবরণ অনুষ্ঠান। এদিন সকাল ৮টা থেকেই প্রশাসনিক ভবনের পশ্চিম চত্বরে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। সকাল ৯টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। হঠাৎ সাড়ে ৯টার দিকে ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। হামলায় প্রথম শহীদ হন সাব্বির আহমদ। এরপর আবদুল হামিদ, আইয়ুব আলী ও আবদুল জাব্বারও শাহাদাত বরণ করেন। আহত হন আরও অনেকে। সেই থেকে ১১ মার্চকে 'শহীদ দিবস' হিসেবে পালন করে আসছে সংগঠনটি।
বিজ্ঞাপন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। এরপর ১৯৫৯, ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৫ এবং ১৯৭০ সালে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ২৮ বছর বিরতির পর ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন ভিসিঅধ্যাপক আবদুল খালেকের সময়ে সপ্তম সমাবর্তন হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে অধ্যাপক আবদুস সোবহানের সময়ে অষ্টম, ২০১৫ সালে অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিনের সময়ে নবম এবং ২০১৮ সালে দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর একাদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
প্রায় ৬ বছর পর এবং আওয়ামী সরকারের পতনের পর আয়োজিত এই সমাবর্তনে যোগ দিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারা। তারা মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সিনেট সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের (রুয়া) সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান এবং রাজশাহী মহানগরীর নায়েবে আমির অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর।

বিজ্ঞাপন
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন পর আমরা আসতে পেরেছি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এখানে আমাদের প্রবেশাধিকার কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। অনেকদিন পর পরিচিত মুখ ও সহকর্মীদের সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগছে। শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় এমন আয়োজন নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন।’ তিনি আরও দ্রুত সিনেট নির্বাচনের দাবি জানান।
মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, কিন্তু ছাত্রাবস্থায় সমাবর্তন পাইনি। আজ সিনেট সদস্য এবং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে এখানে উপস্থিত হতে পেরে আমি সত্যিই আপ্লুত। এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি ধূলিকণায় আমাদের অনেক স্মৃতি ও সহযোদ্ধাদের শাহাদাতের ইতিহাস জড়িয়ে আছে।’
অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘ভিসি মহোদয় রাকসু ও রুয়া সচল করেছেন, সমাবর্তন আয়োজন করেছেন; এখন আমাদের প্রত্যাশা তিনি দ্রুত সিনেট অধিবেশন ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করবেন।’
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করেন। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। এছাড়া ভিসিঅধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ বক্তব্য প্রদান করেন।
এবারের সমাবর্তনে অংশ নিতে ৫ হাজার ৯৬৯ জন গ্র্যাজুয়েট নিবন্ধন করেছিলেন। এর মধ্যে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডিসহ বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীরা তাদের সনদ গ্রহণ করেন। সমাবর্তন সভাপতি প্রতীকী হিসেবে ৯ জন কৃতি শিক্ষার্থীর হাতে সরাসরি সনদপত্র তুলে দেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ ও অধ্যাপক মুর্শিদা ফেরদৌস বিনতে হাবিব।

দীর্ঘদিন পর আয়োজিত এই সমাবর্তন ঘিরে পুরো ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল 'সাবাস বাংলাদেশ' চত্বর থেকে শুরু করে পুরো প্যারিস রোড।
প্রতিনিধি/একেবি

