ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরমজলিশপুর ইউনিয়নের চান্দলা গ্রামের মৌলভী ও হেকিম আবদুর ছাত্তার শান্তি কমিটির ধাওয়ায় পালাতে গিয়ে আর ফেরেননি। ফেনী শহরের মাস্টার পাড়ায় তার দুই হাতে পেরেক মেরে বুক ছিঁড়ে হত্যা করে লাশ অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে পরবর্তীতে স্বজনরা জানতে পেরেছেন।
যুদ্ধের পরের বছরের পর বছর আবদুর ছাত্তারের ওয়ারিশরা জেলার বিভিন্ন স্থানে লাশের সন্ধান করেও কোনো হদিস মেলাতে পারেনি। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের অভাবে স্বীকৃতিও পাননি। এক পর্যায়ে লাশ ও স্বীকৃতি না পেয়েই হাল ছাড়তে হয়েছে স্বজনদের।
বিজ্ঞাপন
মুক্তিযুদ্ধে বাবার বাস্তবতার গল্পের স্মৃতিগুলো বলছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর ছাত্তারের মেয়ে হোসনেয়ারা। তিনি জানান, বাবা ছাত্তার মৌলভী ছিলেন ভাসানী ন্যাপপন্থী নেতা। তিনি বিভিন্ন সময়ে কবিতা লিখে তা আবৃত্তি করে সাধারণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। ফেনী সদর উপজেলার সুন্দরপুর ও সোনাগাজীর কুঠির হাটসহ বিভিন্ন বাজারে হেকিমী ওষুধ বিক্রি করে ১০ সন্তানের সংসারের ব্যয়ভার বহন করতেন দেশপ্রেমিক আব্দুস ছাত্তার।
হোসনেয়ারা জানান, আমার বয়স তখন ৯/১০ বছর। দেশজুড়ে চলছে যুদ্ধ। ১০ শ্রাবণ (সম্ভাব্য তারিখ) কুঠির হাট থেকে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকাররা। বাবাকে সারা রাত বিষ্ণপুর স্কুলের ক্যাম্পে উপোষ রেখে ভোর রাতে কুঠির হাটের তৎকালীন কসাইখানার পাশে নিয়ে যাওয়া হয় হত্যা করার জন্য। সেখানে আগে ৬ জনকে হত্যা করে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাবাকে গুলি করার জন্য তারা প্রস্তুতি নিলে তিনি দুই রাকায়াত নামাজ পড়ার জন্য তাদের নিকট সময় ভিক্ষা চান। তারা রাজি হয়ে সেখানেই নামাজ আদায় করতে বলেন। সেখানে কসাইখানার গরুর রক্ত পড়ে থাকায় বাবা তৎসংলগ্ন কাঠের পুলের ওপর নামাজ আদায়ের অনুমতি চান। একপর্যায়ে শান্তি কমিটি বাবাকে নামাজ পড়তে অনুমতি দেয়। বাবা দুই রাকাত নামাজ আদায় করে মোনাজাত না করেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কচুরীপানার নিচে পালিয়ে যান। সাথে সাথে নদীর পানিতে রাজাকারদের গুলির আওয়াজে আশপাশ প্রকম্পিত হয়। কিন্তু বাবার শরীরে কোনো আঁচ লাগেনি। বাবা কচুরীপানা ধরে পাশ্ববর্তী গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে সকালে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তারা বাবাকে নাস্তা করিয়ে হামলার আশঙ্কায় বাড়ি থেকে বের করে দেন। একপর্যায়ে বাবা আবার চান্দলায় নিজ বাড়িতে চলে আসেন। তখন বাবার চেহারায় ক্ষুধার যন্ত্রণা আর মৃত্যুর ভয়ের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখেছি। আম্মা তড়িঘড়ি করে নারিকেল দিয়ে আব্বাকে পান্তাভাত খেতে দেয়। আব্বা খাওয়া শুরু করতেই বাড়ির দুই চাচা এসে আব্বুর হাতের বাহু ধরে আব্বুকে দাঁড় করিয়ে বলে ‘তুই এখনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যা’ তোকে ধরার জন্য শান্তি কমিটির লোকজন বাড়ির দিকে আসছে’। বাবা পেটপুরে খাবার না খেয়েই গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বালিগাঁও গ্রামের দালাল বাড়িতে (সমি পাটোয়ারী বাড়ি) দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় চায়। কিন্তু সেখানেও বাবার ঠাঁই হয়নি। তাদেরও একই কথা। তোমাকে রাখলে আমাদের বাড়িতেও হামলা হতে পারে। ওই সময়ে চান্দলা মাদরাসার মুহতামিম নুর আহাম্মদের লেখা একটি চিঠি বাবার কাছে পৌঁছে। ওই চিঠিতে বাবাকে ফেনীর একটি স্থানে (নামটা মনে নেই) নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার জন্য অনুরোধ ছিল। চিঠিটি হাতে পেয়েই বাবা পায়ে হেঁটে ফেনীর শহরতলীতে লুদ্দার পাড়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ওই বাড়িটি খুঁজছিলেন।
আবদুর ছাত্তারের ছেলে গিয়াস উদ্দিন জানান, বাড়ি খুঁজতে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা হয় আমাদের প্রতিবেশি মফিজ চেয়ারম্যানের সঙ্গে (তৎকালীন রাজাকার সদস্য)। তিনি আব্বাকে আশ্রয়ের কথা বলে ফেনী শহরের একটি বাসায় নিয়ে যান। সেখান থেকে রাতেই আব্বাকে শান্তি কমিটির লোকজনের হাতে তুলে দেয় মফিজ চেয়ারম্যান।
তিনি জানান, ১৩ শ্রাবণ লোকজনের কাছে জানতে পারি, আব্বাসহ আরও কয়েকজন মুক্তিকামী মানুষকে ফেনী শহরের ট্রাংক রোড এলাকায় গাছের সঙ্গে পেরেক মেরে বুক ছিঁড়ে হত্যা করে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। খবর পেয়ে এলাকার কিছু লোক আব্বাকে দেখার জন্য যায়। কিন্তু আমার বড় ভাই সিরাজ বাবাকে দেখতে এলে তাকেও হত্যা করতে পারে শান্তি কমিটির লোকজন। তাই স্বজনরা ভাইয়াকে আব্বার লাশটাও দেখতে দেয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাইয়া ফেনী ও আশপাশের সকল স্থানে আব্বুর লাশ খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও সন্ধান মেলেনি। তবে যুদ্ধ পরবর্তী ফেনী থেকে প্রকাশিত অর্ধ সাপ্তাহিক পথ পত্রিকায় বাবাসহ সেদিন যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সে প্রতিবেদনেও সেদিনের লাশগুলোর সমাধি স্থান নিয়ে কিছু বলা হয়নি। জানা যায়নি বাবার লাশের স্থান কোথায় হয়েছিল।
গিয়াস উদ্দিন জানান, কুঠির হাটের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার পরও বাবাকে হারালাম। সেদিন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘর থেকে বের হওয়া বাবাকে হারালাম; হারালাম বাবার লাশও। মায়ের কবরের পাশে দাঁড়ালেই বাবার কবর খুঁজি। সবাই তার বাবা মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করে। আমরা এমন পরিবারের সন্তান কখনও বাবার কবরের পাশে দাঁড়ানোর ভাগ্য আমাদের হবে না। আমরা এক হতভাগ্য মুক্তিকামী মানুষের সন্তান।
বিজ্ঞাপন
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর ছাত্তারের নাতি সাংবাদিক নুর উল্লাহ কায়সার জানান, নানার ওপর নির্যাতন আর নানা শহীদ হওয়ার বিষয়টি এলাকার সবাই জানতো। এখন আর প্রত্যক্ষদর্শী কেউ বেঁচে নেই। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকায় নানার নাম উল্লেখ থাকার পরও স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন বড় মামা সিরাজুল ইসলাম। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। তবে প্রয়াত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজ আহাম্মদ চৌধুরী মজলিশপুর ইউনিয়নের চান্দলা গ্রামের একটি সড়কের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর ছাত্তারের নামে করে দিয়ে আমাদের সম্মানিত করেছেন।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর ছাত্তারের নাতি হাফেজ আবদুল্লাহ জানান, বছরের পর বছর আমার চাচা-জেঠারা দাদার লাশের সন্ধানে বহু লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেক জায়গায় গিয়েছেন। কিন্তু দাদার মরদেহ কোথায় রাখা হয়েছে তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পরে স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করেও প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ না দিতে পারায় স্বীকৃতিও পাওয়া যায়নি।
সোনাগাজী উপজেলার চর মজলিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ হোসেন বলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর ছাত্তার প্রথমে নিখোঁজ হন, পরে তাকে হত্যা করে মরদেহ অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের ইউপি কার্যালয় সংলগ্ন নদীর পাড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। ওই স্তম্ভে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর ছাত্তারের নাম ১ নাম্বারে থাকলেও রাষ্ট্রীয় তালিকায় তার নামটি না ওঠা দুঃখজনক বিষয়।
প্রতিনিধি/এফএ

