সারারাত নিস্তব্ধতার মধ্যে খেজুরগাছের মাথায় ঝুলে থাকা হাঁড়িতে টুপটাপ করে জমতে থাকে রস। ভোরের আলো ফুটতেই সেই নিস্তব্ধতা যেন কেমন বদলে যায় গ্রামের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে এক বিচিত্র কোলাহল। সূর্য উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গাছে গাছে উঠে পড়েন গাছিরা। শীতের কাঁপুনিমাখা হাওয়ার মধ্যেও তারা নামিয়ে আনেন রসভর্তি মাটির হাঁড়ি যেন শীতের সকালের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
এক কোণে টিনের পাত্রে জমা হচ্ছে তাজা রস। পাশে জ্বলছে আগুন, ধোঁয়ার নীলচে কুয়াশার মাঝে সেই রস ধীরে ধীরে ঘন হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পরেই তৈরি হচ্ছে সোনালি রঙের সুগন্ধি গুড়। প্রাকৃতিক এই মিষ্টির জন্ম দিতে চাষিদের যে ব্যস্ততা, পরিশ্রম আর অপেক্ষা তা চারপাশে ছড়িয়ে দেয় এক অন্যরকম শীতের উৎসবের আবহ।
বিজ্ঞাপন
দিনাজপুরের গ্রামগঞ্জে এখন এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য প্রতিদিনই দেখা যায়। বিশেষ করে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার ১নং নাফানগর ইউনিয়নের সুলতানপুর বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে সাদামহল রোডে ডা. সরল চন্দ্র রায়ের খেজুরবাগান ইতোমধ্যেই ভোরবেলার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
খেজুরগাছ থেকে হাঁড়ি নামানো, রস ছেঁকে জ্বাল দেওয়া, আর গুড়ের সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠা চারপাশ সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের গল্প। এই দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমান আশপাশের মানুষ থেকে শুরু করে দূরদূরান্তের দর্শনার্থীরা। কেউ গরম রসের স্বাদ নিতে আসেন, কেউ বা ফিরে যান নতুন শীতের গন্ধমাখা স্মৃতি নিয়ে।

গ্রামবাংলার শীতের এই চিরায়ত ঐতিহ্য, গাছি-চাষিদের দক্ষতা আর গুড় তৈরির মুগ্ধকর মুহূর্তগুলো সব মিলিয়ে যেন তৈরি হয় জীবন্ত এক ফিচার, যার প্রতিটি ফ্রেমে ধরা থাকে শীতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
বিজ্ঞাপন
এই বাগানটি তিন বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন ‘উলামা অর্গানিক ফুড’-এর স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হুসাইন।
তাঁর এই বাগানে কাজ করছেন ৬ জন গাছি। তারা প্রতিদিন গাছগুলোতে হাঁড়ি তোলেন ও নামান। সেই রস দিয়ে প্রতিদিন গুড় তৈরি করেন।
ধনতলা শাহপাড়ার শিক্ষিকা রুমি আক্তার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, ‘শুনেছিলাম এখানে কাঁচা খেজুরের রস পাওয়া যায়। তাই ভাই, বোন, বোনজামাই সবাই মিলে এসেছি। জীবনে প্রথমবার রস খেলাম। এমন স্বাদ আগে কখনো পাইনি।’
পীরগঞ্জ থেকে আসা বিপ্লব বলেন, ‘খেজুরের রস অনেকবার খেয়েছি, কিন্তু বাগানে এসে এই প্রথমবার খেলাম। এখানকার রসের স্বাদই আলাদা। আমরা অনেক বন্ধু মিলে এসেছি, দারুণ মজা করে রস খেলাম।’
সেতাবগঞ্জ থেকে তরুণ মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘গাছ থেকে নামানো টাটকা রস অভিজ্ঞতাই আলাদা। গ্রামের পরিবেশ আর রসের ঘ্রাণ সব মিলিয়ে অসাধারণ।’

‘উলামা অর্গানিক ফুড’-এর স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হুসাইন বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকেই আমি গুড়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আগে ঠাকুরগাঁওয়ে কয়েকজন মিলে অর্গানিক পদ্ধতিতে গুড় উৎপাদন করতাম। এবার বোচাগঞ্জে প্রথমবারের মতো নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করেছি। আমরা হোম ডেলিভারি ও অনলাইনে পণ্য সরবরাহ করি। আমাদের গুড় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, স্বাস্থ্যসম্মত এবং ভেজালমুক্ত।’
প্রতিনিধি/একেবি

