৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে দেশ যখন উত্তাল, তখন পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি নামের এক গৃহবধূ। সেই সময়ে ২৮ বছর বয়সি এই ফুলমতির বয়স এখন ৮২ বছর। আর দেশ স্বাধীনের ৪৫ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ায় ফুলের মতো হাসি ফুটে ফুলমতির। কিন্তু সেই হাসি যেন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত কারণে তার শরীরজুড়ে নানা রোগের বাসা বেঁধেছে। এরই মধ্যে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে গৃহবন্দী জীবন পার করছেন এই বীরাঙ্গনা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ খোঁজ রাখে না বলে স্বজনদের অভিযোগ।
রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতির বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলা শহরের উত্তরপাড়ায়। তিনি মৃত কুশিরাম সরকার ফসিয়ার স্ত্রী।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি সকালের দিকে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়- বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা ফুলমতি। এসময় তার ছেলে মনিরাজ কুমার সরকারসহ অন্যান্য স্বজনরা তাকে সেবা করছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুশিরাম সরকার ফসিয়া ছিলেন অত্যন্ত একজন গরিব মানুষ। নিজের জায়গা জমি না থাকায় সরকারি খাস জমিতে বসবাস করতেন। এখান থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন তিনি। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এক বিহারির সঙ্গে হঠাৎ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা তার বাড়িতে প্রবেশ করে স্ত্রী রাজকুমারি রবিদাস ফুলমতিকে ঘর থেকে বের করে নানাভাবে নির্যাতন করে। এভাবে পাক হানাদারের হাতে লাঞ্ছিত হয় ফুলমতি। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী, ৪ ছেলে ও এক মেয়ে রেখে ১৯৮৮ সালে কুশিরাম সরকার ফসিয়া মারা গেছেন। এরপর ফুলমতির জীবনে আরও নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া।
এদিকে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার চেয়েছিলেন। এ নিয়ে সরকারি দফতর ও স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে দীর্ঘ ৪৫ বছর লড়াইয়ের পর গত ২০১৬ সালের মার্চ মাসে স্বীকৃতি পেয়েছেন এই বীরাঙ্গনা। এরপরই ফুলের মতো হাসি ফুটে ফুলমতির মুখে। সুস্থ শরীরে বীরদর্পে চলাফেরা করে আসছিলেন তিনি। এরই একপর্যায়ে বয়সের ভারে নুয়ে পড়ার কারণে অসুখ তার পিছু ছাড়ছে না। প্রায় দুই বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে ডান হাত-পা অবশ হয়। মন চাইলে আর চলতে পারেন না এদিক-সেদিক। অসুখ-বিসুখ লেগে থাকায় তিনি এখন গৃহবন্দী। দিনরাত আঙিনা আর বিছানা তার সঙ্গী। আবার কখনো কখনো তাকে নিতে হয় চিকিৎসকের কাছে। এভাবে দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে এই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা ফুলমতি। তাকে সেবা-যত্নে ছেলে মনিরাজ কুমার সরকারসহ অন্যান্য ছেলে-মেয়ে ও নাতনিরা সর্বদা নিয়োজিত আছেন।

স্থানীয়রা জানায়, এই বীরাঙ্গনার ৪ ছেলের মধ্যে দুই ছেলে রতন ও নিরঞ্জন দিনমজুর। এক ছেলে সুজন সরকারি দফতরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি। আরেক ছেলে মনিরাজ কুমার সরকার ২০১৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। এরপর থেকে একটি সরকারি চাকরির জন্য বিভিন্ন দফতরে আবেদন করাসহ পরীক্ষা দিয়েও তার কপালে জোটেনি সেই কাঙ্ক্ষিত চাকরি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরে স্টোর কিপার পদে আবেদন করলেও সেটির পরীক্ষা এখনও নেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে চাকরির বয়স শেষে হয়েছে মনিরাজ কুমারের।
বীরাঙ্গনা-বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি বলেন, সরকার আমাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছেন। এ জন্য কৃতজ্ঞ। এখন আর শরীর চলছে না। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারি না। দীর্ঘদিন গৃহবন্দী হলেও আজও কোনো সরকারি কর্মকর্তা খোঁজ নেয়নি।
সাদুল্লাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ আজমী বলেন, বার্ধক্যজনিত কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি প্রায়ই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন দিবসে আমরা তার খোঁজ-খবর নিচ্ছি।
প্রতিনিধি/এসএস

