শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঝুলে গেছে মুক্তেশ্বরী নদী উচ্ছেদ প্রক্রিয়া, ক্ষুব্ধ হরিণা বিলপাড়বাসী

ইমরান হোসেন পিংকু, যশোর
প্রকাশিত: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

ঝুলে গেছে মুক্তেশ্বরী নদী উচ্ছেদ প্রক্রিয়া, ক্ষুব্ধ হরিণা বিলপাড়বাসী
ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী দ্রুত দখল উচ্ছেদের দাবিতে শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুরে ভাতুড়িয়া ছোট নারায়ণপুর ব্রিজের পাশে সমাবেশ করেছেন।

যশোরের ভাতুড়িয়ায় মুক্তেশ্বরী নদী দখল করে তৈরি করা প্লট উচ্ছেদ প্রক্রিয়া ঝুলে গেছে। নদী দখলের সত্যতা মেলায় গত অক্টোবর মাসে জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায় এই দখল উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ বিলম্বিত হওয়ায় ‘নদীখেকো’রা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। আদালত থেকে তারা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, দখল উচ্ছেদ বিলম্বিত হওয়ায় হরিণা বিলাপাড়ের বাসিন্দাদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী দ্রুত দখল উচ্ছেদের দাবিতে শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুরে ভাতুড়িয়া ছোট নারায়ণপুর ব্রিজের পাশে সমাবেশ করেছেন। সমাবেশ থেকে তারা দাবি করেন, দ্রুত দখল উচ্ছেদ করে বিল থেকে পানি নামিয়ে দিলে প্রায় এক হাজার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ সম্ভব হবে।


বিজ্ঞাপন


Jashore_Muktesshori_dokhol_pic_03

স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ ধরে ধীরে ধীরে দখল প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একটি প্রভাবশালী চক্র যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া ও ভাতুড়িয়া পূর্বপাড়ার মাঝের মুক্তেশ্বরী নদীর সম্পূর্ণ অংশ ভরাট করে নেয়। এরপর গত জুলাই মাসে জমিতে প্লট তৈরি করে বিক্রির জন্য নোটিশ টাঙানো হয়। এ নিয়ে গত আগস্ট মাসে সংবাদ প্রকাশ হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এই দখল উচ্ছেদে স্থানীয়রা একাট্টা হলে গত ২৪ আগস্ট জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায় বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে এবং একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কমলেশ মজুমদারের নেতৃত্বে চার সদস্যের এই কমিটি ২৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে। এই প্রতিবেদনে মুক্তেশ্বরী নদী দখলের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। মুক্তেশ্বরী নদীর ভাতুড়িয়া মৌজা অংশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় সিএস রেকর্ডে মুক্তেশ্বরী নদীর ভাতুড়িয়া অংশে চাঁচড়া জমিদার রাজা বরদাকান্ত রায়ের নামে সিএস ১৯৭৮ ও ১৯৮০ নং দাগের ৩৮১ শতক খাল শ্রেণি হিসেবে রেকর্ড হয়ে মুক্তেশ্বরী নদীর অংশ হিসেবে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এসএ রেকর্ডেও রাজা বরাদাকান্ত রায়ের ওয়ারেশগণের নামে ওই জমি খাল শ্রেণি হিসেবে নদীর অংশ এবং উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু এরপর আরএস মাঠ জরিপে সরকারের পক্ষে কালেক্টর, যশোরের নামে ৩৪০ শতক খাল ও ধানী হিসেবে রেকর্ড হয়। এরপর আরএস জরিপ রেকর্ডে সেই জমি (৩৮১ শতক) মোস্তফা কামাল উদ্দিন, মোস্তফা জালাল উদ্দিন ও মোস্তফা আওয়াল উদ্দীনের নামে পুকুর ও ধানী জমি হিসেবে রেকর্ড হয়ে যায়।’ অর্থাৎ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্তেশ্বরীর এই অংশ সরকারি হলেও অনিয়মের মাধ্যমে তা ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়েছে।

Jashore_muktesshori_somabesh_pic_02

এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর নদী রক্ষা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড দ্রুততার সাথে উক্ত ভরাট করা অংশ পুনঃখননের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ সহায়তা প্রদান করবেন।


বিজ্ঞাপন


এদিকে, নদী রক্ষা কমিটির এই সিদ্ধান্তের পর এক মাস পার হলেও কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার সুযোগ গত ১ ডিসেম্বর যশোর সদর সিভিল জজ আদালতের দ্বারস্থ হন জমির রেকর্ডধারী মোস্তফা জামাল উদ্দিন। আদালত মোস্তফা জামালের আর্জি আমলে নিয়ে মুক্তেশ্বরী খননে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।

ওই জমির কেয়ারটেকার যশোর রেজিস্ট্রি অফিসের এক সময়ের পিয়ন নূর ইসলাম নুরু জানান, ওই জমির মালিক মোস্তফা জালাল উদ্দিন আদালতে মামলা করেছেন। আদালত ওই জমিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।

মুক্তেশ্বরী দখলের প্রতিবেদন এবং আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিশ্চিত করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কমলেশ মজুমদার জানান, তারা আদালতের নির্দেশনা পেয়েছেন। তবে ওই নদীর ওই জমি দখল এবং ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডের সত্যতা তারা পেয়েছেন। এ ব্যাপারে যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এদিকে, এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ভাতুড়িয়ার বিল হরিণা এলাকার মানুষ। তারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, দ্রুত মুক্তেশ্বরী খনন হলে বিল হরিণার জলাবদ্ধ এলাকার পানি নেমে যাবে। এতে অন্তত এক হাজার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ সম্ভব হবে। কিন্তু এই দীর্ঘসূত্রতায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে।

ভাতুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা মাসুদুর রহমান জানান, হরিণার বিলপাড়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে মুক্তেশ্বরীর এই প্লট অপসারণের জন্য আন্দোলন করে আসছেন। প্রশাসনের তদন্তে জালিয়াতি করে জমির রেকর্ড ও দখলের সত্যতা উঠে আসায় এবং দখল উচ্ছেদের সিদ্ধান্তে তারা আশাবাদী হয়েছিলেন। তাদের আশা ছিল, দ্রুত নদী খনন করা হলে বিলের পানি নেমে যাবে এবং তারা এবারই বোরো আবাদ করতে পারবেন।

একই এলাকার বাসিন্দা তৌহিদুর রহমান জানান, জমি জালিয়াত চক্রটিকে যখন উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা কাগজপত্র নিয়ে হাজির হতে বলেছিলেন, তখন তারা সেখানে যাননি। এখন আদালতের মাধ্যমে সময় ক্ষেপণের চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে তারা দখল বজায় রাখতে চান। এরপর বিলপাড়ের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।

আরও পড়ুন

ইআইআইএন জটিলতায় অস্তিত্ব সংকটে স্কুল, শিক্ষকদের মানবেতর জীবন

এদিকে, ক্ষুব্ধ বিলপাড়ের বাসিন্দারা শুক্রবার দুপুরে ভাতুড়িয়া ছোট নারায়ণপুর ব্রিজের পাশে গণসমাবেশ করেছেন। জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও এলাকাবাসী এবং বিল হরিণা বাঁচাও আন্দোলন কমিটির আয়োজনে গণসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর মোসলেম উদ্দিন। বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যশোর জেলা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আজিজুল হক মনি, বিল হরিণা বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক শেখ রাকিবুল ইসলাম নয়ন, বাপা যশোর জেলা কমিটির সদস্য সচিব আতিকুর রহমান, বিল হরিণা বাঁচাও আন্দোলনের ভাতুরিয়া আঞ্চলিক কমিটির সদস্য সচিব মাসুদুর রহমান টিটো প্রমুখ।

সমাবেশে নেতারা বলেন, মুক্তেশ্বরী নদীর অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সেইসঙ্গে আইনি লড়াইয়ের জন্য বিল পাড়ের সমস্ত মানুষকে সাথে নিয়ে লড়তে হবে। অবৈধ দখলদারদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিতে হবে।

নেতারা উল্লেখ করেন, মুক্তেশ্বরী নিয়ে প্রশাসন আজ জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা মুক্তেশ্বরীর অবৈধ দখল উচ্ছেদে কাজ চালিয়ে যাব। যশোর জেলার প্রশাসন ইতোমধ্যেই দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে-এ জন্য আমরা ধৈর্য ধরে পাশে আছি। আমরা চাই প্রশাসত দ্রুততম সময়ে আইনি জটিলতা কাটিয়ে মুক্তেশ্বরী দখল অবমুক্ত করবে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর