বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

রমণীর সুঁচের ফোঁড়ে রঙিন হাতপাখা

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ০৫ জুলাই ২০২২, ০৯:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

রমণীর সুঁচের ফোঁড়ে রঙিন হাতপাখা
ছবি : ঢাকা মেইল

গ্রামের নাম ‘আড়োলা’। লোডশেডিং বাড়তেই গ্রামে চিরচেনা এক রূপ ফিরে আসে। প্রায় বাড়িতে হাত পাখা তৈরির ধুম পড়ে যায়। ডাটা পাখা, হরতন পাখা, ঘুরকি পাখা, পকেট পাখা ও আমান পাখা নামের বিভিন্ন পাখা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন গ্রামের নারীরা। তারা এসব হাতপাখাতে সুঁই-সুতা দিয়ে বাঁধা ও রঙের কাজ করেন পরম ধৈর্য্য ও যত্ন নিয়ে। তাদের কোমল হাতের সুঁচের ফোঁড়ে রঙিন হয়ে ওঠে প্রতিটি পাখা। এই কাজে সহায়তা করেন বাড়ির পুরুষরা। শুধু তাই নয়, বাড়ির শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত কেউই বসে থাকেন না। সবাই যার যার মতো করে হাতপাখা বানানোর কাজ করেন। 

গ্রীষ্মকালের এই সময়টাতে তাদের প্রচণ্ড ব্যস্ততায় কাটে। কাঠফাঁটা এই গরমে মানুষ যখন হাঁসফাঁস করে তখন তাদের মুখে হাসি ফুটাতে দিনরাত পরিশ্রম করেন বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নে আড়োলা গ্রামের কারিগররা। আড়োলা ছাড়াও আতালপাড়া, যোগীরভবনসহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের তালপাতার পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কারিগররা।


বিজ্ঞাপন


সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাস থেকে হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয়ে চলে ভাদ্র মাস পর্যন্ত। জৈষ্ঠ্য মাস পার হলে কাজের চাপ কমতে থাকে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম।

হাতপাখা তৈরির গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এবারও ফালগুন মাস থেকে তালপাতার পাখা তৈরির কাজ শুরু করেছে এখানকার পাখা তৈরি কারিগররা। কবে হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও প্রবীণ ব্যক্তিদের মতে এক শ বছর বা তারও বেশি আগে আড়োলা গ্রামে তালপাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয়। আর তখন থেকেই গ্রামের পেশা হিসেবে বেছে নেয় হাতপাখা তৈরির কাজ। তাদের বাপ-দাদার আদি পেশা এই তালপাতা দিয়ে পাখা তৈরির কাজ। একসময় হাত পাখা তৈরির কাজ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে।

নারী-পুরুষ মিলে সবাই তৈরি করছে বিভিন্ন প্রকারের সৌখিন তালপাতার হাতপাখা। পুরুষেরা কাঁচা বাঁশের কাজ করছেন। আর নারীরা সুঁই-সুতা দিয়ে পাখা বাঁধানো ও রঙের কাজ করছেন। পাখার চাহিদা মেটাতে গরম মৌসুমে নারী-পুরুষের দম ফেলার সময় পাচ্ছে না। চুলায় ভাত-তরকারি তুলে দিয়ে পাখা তৈরির কাজ নিয়ে বসেন তারা। 

শিশু-কিশোরেরাও লেখাপড়া ও খেলাধুলার পাশাপাশি মা-বাবার সঙ্গে পাখার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারেরা আসেন পাখা নিতে। আবার অনেকে কারিগরদের আগাম টাকা দিয়ে পাখা তৈরি করিয়ে নেন। ভাদ্র মাস পর্যন্ত কারিগরদের এই ব্যস্ততা থাকবে জানা গেছে। 


বিজ্ঞাপন


কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গরমের তীব্রতা যত বাড়বে ততই বাড়বে পাখা তৈরি তাদের ব্যস্ততা। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা ছুটে আসছে পাখা কেনার জন্য। 

এখানকার ৪-৫টি গ্রামের প্রায় ৫ শ পরিবার তালপাতার পাখা তৈরি করে থাকে। এদের মধ্যে কেউ শ্রমিক হিসেবে, আবার কেউ নিজের টাকায় পাখা তৈরি করেন। আবার স্থানীয় কয়েকজন মহাজন শ্রমিক খাটিয়ে প্রতি মৌসুমে ৩০-৪০ হাজার পাখা তৈরি করে নিয়ে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকে। 

কারিগররা জানিয়েছে, ৫ প্রকারের পাখা তৈরি হয়। এসব পাখার নাম দেওয়া হয়েছে—ডাটা পাখা, হরতন পাখা, ঘুরকি পাখা, পকেট পাখা ও আমান পাখা। এখানে পাখা তৈরির কাজে নারীরা অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। নারীরা সংসারের কাজের পাশাপাশি এই পাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করে থাকেন। নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য বিভিন্ন মহাজনের পাখা তৈরি করে। চুক্তিভিত্তিক ১ শ পাখা তৈরি করলে পাখার প্রকারভেদে তারা ৬০ থেকে ১ শ টাকা পায়। 

চুক্তিভিত্তিক পাখা তৈরিকারক পারভীন, সহিদা, বৃষ্টি জানান, পাখা তৈরি থেকে শুরু করে পাখা তৈরির আনুষঙ্গিক কাজের ওপর নির্ভর করে তারা পারিশ্রমিক পায়। 

মহাজন সালাম জানান, তারা সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন তালপাতা সংগ্রহ করাসহ পাখা তৈরীর কাজে। পাখা তৈরির শুরুর ২/৩ মাস আগে থেকে নওগাঁ ও জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে তালপাতা কিনে এনে মজুদ করেন। পাখা তৈরি করে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি দরে বিক্রি করে। 

সালাম বলেন, এখানকার তৈরি করা তালপাখা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা বিক্রি হয়। প্রতি মৌসুমে এখানকার স্থানীয় মহাজনেরা এই ব্যবসায় ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করে। 

পাবনা থেকে পাখা কিনতে আসা ব্যবসায়ী মামুন শেখ ও মিরাজুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে যত তালপাতার পাখা তৈরি হয় তার বেশির ভাগই এখানে তৈরি হয় বলে তারা জানেন। 

সালামের মতো আজগর শেখ বলেন, তালপাতার এই সৌখিন পাখাগুলো সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বিভিন্ন মেলাতে। আগে শখের বসে এলাকরা নারীরা পাখা তৈরি করতো, সেগুলো কেউ কেউ মেলাতে বিক্রি করতো। আর এখন এই পাখা তৈরির কাজ অনেকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। 

পাখা তৈরি কারিগররা বলেন, আধুনিকতার ছোঁয়া সব জায়গাতে ছড়িয়ে পড়লেও  তাদের তৈরি করা পাখার চাহিদা এখনও কমেনি।

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর