শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ঠাকুরগাঁওয়ের আনাচেকানাচে অসংখ্য চা বাগান

মো. জাহিদ হাসান মিলু
প্রকাশিত: ০১ জুলাই ২০২২, ০৬:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ঠাকুরগাঁওয়ের আনাচেকানাচে অসংখ্য চা বাগান

চা চাষে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চল পঞ্চগড়ের পর এখন পার্শ্ববতী জেলা ঠাকুরগাঁওয়েও অসংখ্য চায়ের বাগান গড়ে উঠেছে। চা শিল্পের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে সীমান্ত ঘেঁষে গড়ে ওঠা দিগন্তবিস্তৃত এসব বাগানে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চায়ের আবাদ শুরু হয়েছে এখন জেলার প্রতিটি উপজেলার গ্রামে গ্রামেও। 

জেলা ঘুরে দেখা মেলে, সমতলভূমিতে গড়ে তোলা ছোট-বড় অসংখ্য চা বাগান। বসতবাড়ির পেছনের জমিতে, বাড়ির আঙিনার আশপাশে, রাস্তার ধারে— আনাচকানাচের বিভিন্ন জমিতে এখন চা গাছের সবুজ রংয়ের সমারহে ভরপুর হয়ে উঠেছে। এতে চা শিল্পে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন জেলার চাষিরা।

আরও পড়ুন: বিস্কুট যদি হয় পোড়ামাটির তৈরি— সেটা আবার কেমন!


বিজ্ঞাপন


একসময় যে জমিতে আগাছা ছাড়া কোনো ফসল হত না সেই জমিতে এখন চা গাছের সমারোহ। নদীর ধারে যেসব জমি শুধু গোচারণ ভূমি হিসেবে পড়ে থাকতো, সেই দিগন্তবিস্তৃত জমিও চা চাষে সবুজের লীলাভূমিতে ভরপুর হয়ে উঠেছে। জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর দিগন্তবিস্তৃত চা-বাগান ছাড়াও দেখা গেছে, যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই চায়ের গাছ লাগিয়েছেন। অন্যান্য ফসলের তুলনায় চাষিরা চায়ে লাভবান হওয়ায় দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠাকুরগাঁওয়ে চায়ের চাষ। এতে চা অর্থকারি ফসল হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছে জেলায়। আর এসব বাগানে কাজ করে স্থানীয় অনেক বেকার মানুষেরও কর্মসংস্থান হয়েছে। 

জানা যায়, ১৯৯৯ সালে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে জরিপ চালায় বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। ২০০০ সালের দিকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। পরে ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় প্রথম চা চাষ শুরু হয়। এখন জেলার প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে চা চাষ হচ্ছে।
Tea garden Thakurgaonজেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলায় মোট ২৪১.৭১ হেক্টর জমিতে করা হয়েছে চায়ের বাগান। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫৭.৭২ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় মিলে ৯৩টি চা বাগান রয়েছে। পীরগঞ্জ উপজেলায় ০.৩৯ হেক্টর জমিতে ১টি, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় ১৭৯ হেক্টর জমিতে ছোট বড় মোট ১০০টি, রাণীশংকৈল উপজেলায় ১ হেক্টর জমিতে ৪টি ও হরিপুর উপজেলায় ৩.৬ হেক্টর জমিতে ৩টি চা বাগান রয়েছে।
 
সব থেকে বেশি চা চাষ করা হয়েছে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায়। এ উপজেলায় ১৭৯ হেক্টর জমিতে চা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে রনবাগ ও বেউরঝাড়ী সীমান্ত ফাঁড়ীর কাছে অবস্থিত দুমুখা এবং কলশির মুখে ইসলাম টি এস্টেট নামে মোট ৩টি বাগানে ১৩৩ একর জমিতে চা চাষ করা হয়েছে। এসব বাগানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

আরও পড়ুন: চা পাথর আর কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রাচীন মোহ পঞ্চগড়ে

ইসলাম টি এস্টেট চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন এ কে এম শামসুজ্জামান (বাবলু) ঢাকা মেইলকে বলেন, ৩টি বাগান থেকে গত বছর ১৫ লাখ কেজি চা পাতা সংগ্রহ করা হয়েছে। এবার এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ কেজি পাতা সংগ্রহ করেছি । আশা করছি পুরো বছরে এবারও ১৫ লাখ কেজি পাতা সংগ্রহ হবে। আর এ বাগানের চা পাতাগুলো সংগ্রহ করে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় পঞ্চগড়ের সাজেদা রফিক টি ফ্যাক্টরিতে।

১১ বছর ধরে চা বাগানে কাজ করছেন সুবল চন্দ্রপাল। সকাল বেলা বেউরঝাড়ীর দুমুখা বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার জন্য চা বাগানে স্প্রে করছিলেন তিনি। এসময় তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে কাজ পাইতাম না। সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। গত ১১ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। এখানে কাজ করে যা পাই তা দিয়ে মোটামুটি সংসার ভালোই চলে। বাগানে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করে ২৪০টাকা পাই। পরে আবার ওভার টাইম কাজ করলে বা চা পাতা কাটলে কোন দিন ৫০০ টাকাও দিন হাজিরা পাই।’
Tea garden Thakurgaonবালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বেউরঝাড়ী গ্রামের কৃষক কলিম উদ্দিন দেড় বছর আগে বাড়ির পেছনে ৬ বিঘা জমিতে করেছেন চা বাগান। এবার চা পাতার কেজি ১৪-১৫ টাকা দামে বিক্রি করলেও ৬ বিঘা জমির এক রাউন্ড চা পাতা বিক্রয় করেছেন ২৩ হজার টাকা। তবে তার অভিযোগ ‘সিন্ডিকেটের কারণে চা চাষিরা চা পাতার ন্যায্য মূল পাচ্ছে না ও প্রতি ১০০ কেজি চা পাতায় ২০ কেজি পাতা বেশি দেওয়া লাগে।’


বিজ্ঞাপন


বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তের নিটোলডোবা গ্রামে গ্রিন ফিল্ড টি এস্টেট ২০০৭ সালে ৬০ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। পরে ২০১৭ সালে উপজেলার শাহবাজপুরে ‘গ্রিন ফিল্ড টি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামে একটি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলেন ফয়জুল ইসলাম (হিরু)।

নিটোলডোবায় সরজমিনে দেখা যায়, নাগর নদীর এপারে ও ওপারে দুই পাশেই চায়ের গাছ। এ যেন প্রকৃতিতে কেউ সবুজের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। সবুজের এ গালিচা আর অন্য কিছু নয়, দিগন্তবিস্তৃত চায়ের বাগান। সবুজ রংয়ে পরিবেশকে করছে নয়নাভিরাম।

আরও পড়ুন: তেঁতুলিয়ায় চায়ের জমিনে আমের বিজয়ধ্বনি

বাগানের গাছ থেকে চা পাতা তুলছিলেন, বেদেনা, হাসেনাসহ আরও ৩-৪ জন নারী। তারা বলেন, ‘এখানে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করে ১০০ টাকা হাজিরা পাওয়া যায়। ১টার পর থেকে কাজ করলে ওভারটাইম হিসেবে আরও বেশি টাকা পাই। সীমন্ত এলাকা হওয়ায় এদিকে তেমন কাজ পাওয়া যায় না। তাই বাড়িতে বসে না থেকে বাগানে কাজ করি।’   

৯ বছর ধরে গ্রিন ফিল্ড টি এস্টেট চা বাগানের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন তাজমুল হক। তিনি বলেন, ‘গতবছর এ বাগান থেকে ৫ লাখ কেজির উর্ধ্বে চা পাতা সংগ্রহ করেছি। গতবছরের তুলনায় এবার আরও বেশি পরিমাণ চা পাতা সংগ্রহ করতে পারবো বলে আশা করছি। এছাড়াও এলাকায় দিন দিন নতুন নতুন চা চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে ঠাকুরগাঁও।’
Tea garden Thakurgaonতিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবছর নদী ভাঙনের ফলে চা বাগান নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। নদী ভাঙ্গন রোধে সরকার যদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করত তাহলে আমাদের কোম্পানি ও এখানে যারা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের জন্য ভালো হত। কারণ এখানে চা বাগান আছে বলেও অনেকে কাজ করতে পারছেন। আর যদি এইভাবে দিন দিন নদীভাঙ্গনে ফলে বাগান বিলীন হয়ে শেষ হয়ে যায় তাহলে এখানে যারা কাজ করেছেন তারাও বেকার হয়ে যাবে।’ 

উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের যুবক মো. মোস্তাফিজুর রহমান। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে অর্নাস পাস করে বসে না থেকে বাড়িতে শুরু করেছেন কৃষি কাজ। অন্যান্য ফসল চাষাবাদের পাশাপাশি পতিত ৩৩ শতক জমিতে করেছেন চা বাগান। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এলাকার অনেক মানুষ চা বাগান করে দিন দিন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই আমিও পরীক্ষামূলকভাবে ৩৩ শতক জমিতে চাষ শুরু করেছি। ফলন ও দাম পেলে আরও বেশি জমিতে চাষ করবো। সরকার যদি এ জেলায় চা বোর্ড ও চা প্রক্রিয়াকরণের জন্য কারখানা করেন তাহলে চায়ের জন্য বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ হবে ঠাকুরগাঁও।’

আরও পড়ুন: লিটনের হাত ধরে কুষ্টিয়ায় ‘ইউটিউব ভিলেজ’, আছে পার্কও

ঠাকুরগাঁও জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. জাহিদ ইকবাল। তেঁতুলিয়ায় তার এক সহকর্মীকে চা চাষ করতে দেখে তিনিও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লাহিড়ী শাহবাজপুরে ২০১৮ সালে ৩ একর জমিতে টিভি-২৬ জাতের চা চাষ শুরু করছেন। সেই বাগন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার কেজি চা পাতা উত্তোলন করেছেন তিনি। দামও পেয়েছেন ভালো। ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জেলায় চা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সরকারিভাবে চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও জেলায় চা বোর্ডের অফিস করা হয়। চা পাতার দাম নিয়ন্ত্রণে কমিটি গঠন করা হলে এ জেলায় বিশ্ব ও উন্নতমানের ব্যাপক চা উৎপাদন করা সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে এপর্যন্ত চা পাতার দাম কমে যাওয়ায় চা চাষিদের অবস্থা বেশি ভালো না। বাজারে চা কিনতে গেলে দাম বেশি আর চা পাতা বিক্রয় করতে গেলে দাম কম। তিনি বলেন, ‘এখানে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেট রোধে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
Tea garden Thakurgaonসদর উপজেলার ক্ষুদ্র চা চাষি মেহেদি আহসান উল্লাহ জানান, ‘সরকারি উদ্যোগে কারখানা স্থাপন এবং চা চাষে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা নিলে এ এলাকায় চায়ের চাষ আরও প্রসারিত হবে।’

অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছোট ছোট বাগান গড়ে তুলেছেন আরও অসংখ্য চাষি। যেমন পীরগঞ্জ উপজেলার বৈরচুনা গ্রামে ৬৬ শতক জমিতে চা বাগান করেছেন শাহিনুর রহমান, রাণীশংকৈল উপজেলার ইশ্বর চন্দ্র, সফিকুল ইসলাম, খালেক, আলমগীর। হরিপুর উপজেলার তোফাজ্জল হোসেন, শওকত আলী, আবু তাহের এই ৩ চাষি ৩.৬ হেক্টর জমিতে করেছেন চায়ের বাগান। এছাড়াও সদর উপজেলার ৮৫ জন ৫৭.৭২ হেক্টর জমিতে ৯৩টি বাগান করেছেন। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবীদ মো. আবু হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের ভৌগলিক ও ভূমি অবস্থান ভালো। এখানকার মাটি যেমন অন্যান্য ফসলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী তেমনি চায়ের জন্যেও খুব উপযোগী। তবে যে জমিগুলো বেশি উর্বর ও অন্যান্য ফসল ভালো ফলে, সেই জমিগুলো বাদ দিয়ে যদি নদী অববাহিকা ও যেগুলো জমিতে অন্যান্য ফসল ভালো হয় না সেই জমিতে চা চাষ করা হয়, তাহলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবেন। তাছাড়াও চা বোর্ড যদি চা চাষিদের সার্বিক সুযোগ সুবিধা, বাজার জাতকরণসহ অন্যান্য বিষয়গুলো নিশ্চিত করেন তাহলে এজেলায় চা হবে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল।’

আরও পড়ুন: নীলফামারীতে ব্রিটিশ রানির বিলাসবহুল সেলুন কোচ

চা পক্রিয়াজাকরণ ফ্যাক্টরি মালিকদের সঙ্গে চাষিদের সমন্নয় করে চা চাষ করার পরামর্শের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কৃষকরা যাতে চা পাতা যথাযথ মূল্যে বিক্রয় করতে পারেন, সেটি চা বোর্ডকে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে কৃষকরা লাভবান হবেন।’ কৃষি বিভাগ থেকে চা গাছের পরিচর্যা, সার ও বালাইনাশক ব্যবহারে সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।

ঠাকুরগাঁওয়ে চা শিল্পের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল বলে ঢাকা মেইলকে জানান জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, জেলায় চা বোর্ড অফিস স্থাপনের জন্য জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি একটি আবেদন করেছিলাম। তবে এখনই এই জেলায় চা বোর্ড স্থাপন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে কেউ যদি ব্যক্তি মালিকানায় চা ফ্যাক্টরি করতে চায় তাহলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হবে।

প্রতিনিধি/এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর