চলতি আউশ মৌসুমেও চুয়াডাঙ্গায় ফের তীব্র সারসংকট দেখা দিয়েছে। জেলার চারটি উপজেলায় ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি; এই তিন ধরনের সার সরকারি ডিলার পয়েন্টে প্রায় অনুপস্থিত। অথচ খুচরা বাজারে সেই সার মিলছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ দামে। এতে করে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন প্রান্তিক কৃষকেরা।
কৃষকদের অভিযোগ, সরকারি ডিলারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার মিলছে না। অথচ গ্রাম-গঞ্জের খুচরা দোকানে সার পাওয়া যাচ্ছে চড়া দামে। তাদের দাবি, একটি সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে জেলা কৃষি বিভাগ এবং প্রশাসন বিসিআইসি ও বিএডিসি অনুমোদিত ডিলারদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করলেও এখনো কার্যকর কোনো সমাধান আসেনি।
মাঠের বাস্তব চিত্র
জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন ধান, পাট, পেঁপে ও আগাম শীতকালীন সবজির চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। এই সময়ে ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি সারের চাহিদা ব্যাপক। তবে সঠিক সময়ে সারের সরবরাহ না থাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের কৃষক এনামুল হক বলেন, ‘ভোটার আইডি দেখিয়ে ডিলারের কাছ থেকে মাত্র ১০-২০ কেজি সার মিলছে। অথচ আমার প্রয়োজন ২০০ কেজি।’
একই গ্রামের কৃষক আকাশ হোসেন বলেন, ‘এখন আমাদের চাষাবাদের মৌসুম চলছে। অথচ ডিলারের কাছে গেলে চাহিদামতো সার পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা দোকানে গেলে অবশ্য সার পাওয়া যায়, তবে দাম দ্বিগুণ। বাধ্য হয়েই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।’
বিজ্ঞাপন
বেলগাছি ইউনিয়নের কৃষক মামুন হোসেন বলেন, ‘যে সারের সরকারি মূল্য ১ হাজার৩৫০ টাকা, সেটাই এখন খুচরা বাজারে কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকায়। এতে চাষাবাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে, আমরা কৃষকরা দিশেহারা।’
আলমডাঙ্গার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক সরোয়ার আলম বলেন, ‘যে সময়ে সারের দরকার, তখন যদি না পাওয়া যায়, তাহলে ফসল ভালো হয় না। তাই বাধ্য হয়ে চড়া দামে সার কিনছি।’

ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের বক্তব্য
আলুকদিয়া বাজারের বিসিআইসি অনুমোদিত সার ডিলার ‘বিশ্বাস ট্রেডার্স’-এর পক্ষ থেকে শাওন বিশ্বাস জানান, ‘বর্তমানে নন-ইউরিয়া সারের সরবরাহ কিছুটা কম। কৃষকরা সবাই একসঙ্গে সার চাইছেন। আমরা যে পরিমাণ সার পাচ্ছি, তা সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে হচ্ছে।’
ভালাইপুর বাজারের খুচরা সার ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘জেলার বাইরে থেকে সার এনে কৃষকদের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। এতে খরচ বেশি হওয়ায় দামও বাড়তি। সংকট সামাল দিতেই এমনটি করতে হচ্ছে।’
আরেক খুচরা বিক্রেতা মিন্টু আলী বলেন, ‘ডিলার ও পাইকারি পর্যায় থেকে বস্তাপ্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। ফলে আমাদেরও উচ্চ দামে বিক্রি করতে হয়। অনেক সময় দূর-দূরান্ত থেকে সার আনতে হয়, সেটাও বাড়তি ব্যয়।’
প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের প্রতিক্রিয়া
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, ‘সরকার কৃষকদের জন্য ভর্তুকিমূল্যে সার সরবরাহ করছে, যাতে তারা সঠিক সময়ে চাষাবাদ চালিয়ে যেতে পারেন। যদি কেউ কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘তথ্য অনুযায়ী জেলায় সারের কোনো ঘাটতি নেই। তবে বাস্তব পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হবে। কে কোথা থেকে সার উত্তোলন করছে এবং কোথায় বিতরণ করা হচ্ছে, তা মনিটর করা হচ্ছে। কোনো কৃষক যদি অভিযোগ করেন, তাহলে তা গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তামাক চাষিরা সরকারি ভর্তুকিমূলক সার পাওয়ার উপযুক্ত নন। চুয়াডাঙ্গায় দু’টি তামাক কোম্পানি রয়েছে। তাদের মাধ্যমে তামাক চাষিদের জন্য আলাদা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে, মাছ চাষের জন্য মৎস্য কর্মকর্তার মাধ্যমে আলাদা সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হবে।’
সার বরাদ্দ ও সরকারি মজুদ থাকলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষকেরা চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছেন না। এ অবস্থার জন্য বিতরণব্যবস্থার ত্রুটি, দুর্বল তদারকি এবং সিন্ডিকেট চক্রকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখনই কঠোর নজরদারি ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিনিধি/একেবি

