রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বড় মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করায় ছোট মেয়েকে ৪ বছর ঘরে বন্দী!

মো. শামীম কাদির, জয়পুরহাট
প্রকাশিত: ২৭ জুলাই ২০২৫, ০৭:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

বড় মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করায় ছোট মেয়েকে ৪ বছর ঘরে বন্দি!

অসহায় এক মেয়ের নাম লিজা। সে চার বছর ধরে দেখেনি সূর্যের আলো, নির্মল সুপ্ত বাতাস। তার কোনো অপরাধ না থাকলেও বড় বোন পালিয়ে বিয়ে করাটাই যেন তার বড় অপরাধ। একারণেই তাকে টানা চার বছর ধরে বদ্ধ ঘরে আটকে রাখেন তার বাবা এনামুল হক। তাকে নিয়মিত দেওয়া হতো ঘুমের ইনজেকশন। এর প্রতিবাদ করলেই বাবা এনামুল ও সৎ মা দু’জনে মিলে চালাতো শারীরিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে হারিয়ে ফেলে মানসিক ভারসাম্য। এমনই এক ভয়ংকর অভিযোগ উঠেছে বাবার বিরুদ্ধে।

খবর পেয়ে আক্কেলপুর পৌর এলাকার হাসপাতালের পেছনে এনামুলের বাড়ি থেকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় মানসিকভাবে অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করে পুলিশ।


বিজ্ঞাপন


সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ির প্রধান ফটকে ঝুলছিল তালা। বাবা ছিল গ্রামের বাড়িতে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখে এলাকাবাসী তার বাড়ির সামনে হইচই করছিল। বাবা ফিরে এসে এলাকাবাসীর তোপের মুখে বাড়িতে তালা খুলে প্রবেশ করেন। গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সব জানালা দরজা বন্ধ। এমনকি জানালা দরজা যেন খুলতে না পারে সেজন্য জানালা দরজাতে টিন ও কাঠ দিয়ে ঘেরা। মেয়ের ঘরে একটি ছোট ফ্যান আর একটি বাতি। এছাড়াও বাড়ির ভেতরে নেই কোনো তেমন বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা। বাড়ির প্রতিটি আসবাব পত্রে লেখা আছে ‘ডা. এনামুল’। বাড়িতে আলো বাতাস না আসায় মনে হয় এ যেন একটা ভুতুড়ে বাড়ি। সারা ঘর এলোমেলো। সেই বাড়িতে দীর্ঘ চার বছর ধরে বন্দী করে রেখেছেন এসএসসি পাশ মেয়েকে। মেয়ে যেন কারও সাথে কথা না বলে এজন্য মেয়েকে ঘরবন্দী করে রেখে চেতনানাশক ইনজেকশন করতেন নিয়মিত। চালানো হতো নির্যাতন।

IMG-20250727-WA0026

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৫ বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট এনামুল হকের বড় মেয়ে লিমা আক্তার ভালোবেসে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। এরপর ৪ বছর আগে ২০২১ সালে ছোট মেয়ে সুরজিনা আক্তার জাহান হক লিজাকে এসএসসি পাশের পর থেকেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে নিজ বাড়িতে একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখে বাবা এনামুল হক। এরপর মেয়েটিকে বেশির ভাগ সময় ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হতো। কখনও মেয়ে প্রতিবাদ করলেই বাবা এনামুল ও সৎমা দু’জনে মিলে শারীরিক নির্যাতন চালাতো। এক পর্যায়ে বাবা তার মাথা ন্যাড়া করে দেয়। ওই বাড়িতে প্রতিবেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এনামুল হক। কোনো প্রতিবেশীসহ কাউকে প্রবেশ করতে দিতেন না তিনি। বাইরে থেকে সব সময় বাড়ির প্রাধান গেটে ঝুলত তালা। তবে প্রতিবেশীরা মেয়েটির নির্যাতনের আর্তনাদ শুনতে পেত। এর ফলে আস্তে আস্তে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। এনামুলের ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না।

মেয়েটির ওপর এমন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয়রা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ এসে বাড়িতে প্রবেশ করে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। এরপর আপাতত মেয়েটিকে মুক্ত করে দ্রুত চিকিৎসার জন্য বাবাকে নির্দেশ দেয় পুলিশ।


বিজ্ঞাপন


IMG-20250727-WA0025

স্থানীয় বাসিন্দা ও তাদের প্রতিবেশী তুহিন বলেন, লিজা নামে মেয়েটি আগে সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল। লেখাপড়াও ভালো করত। প্রায় ৪ বছর আগে লিজার বোড় বোন লিমা ভালোবেসে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। ছোট মেয়ে যেন এমন কাজ না করতে পারে এজন্য কয়েক বছর ধরে নিজ বাড়িতে আবদ্ধ করে রাখে তার বাবা। গত ৪ বছর ধরে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি মেয়েটাকে। চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে মেয়েটি মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে।

আরেক প্রতিবেশী সাফসান রাসিক জনি বলেন, মেয়েটিকে তার বাবা এনামুল বদ্ধ ঘরের মধ্যে আটকে রেখে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুমিয়ে রাখতো। কোনো এক সময় মাথার চুলও কেটে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে মেয়েটি ঘরের ভেতর আর্তনাদ করে চিৎকার করত। খারাপ লাগলে এনামুলের দাপটে কথা বলার সাহস হয়নি। মেয়েটিকে এখন চিকিৎসা করলেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় এনামুলের বিচার দাবি করছি।

IMG-20250727-WA0029

লিজার সৎ মা ফেরজা ওরফে ফেতু জানান, তার স্বামী প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তবে স্বামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনও কথা বলার সাহস হয়নি। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় গেটে তালা দিয়ে বের হয়। আবার ফিরে এসে তালা খুলে দেয়।

আরও পড়ুন

৭৬ বছর বয়সী বাবার কাঁধে ২ প্রতিবন্ধী সন্তান, মানবেতর জীবনযাপন

লিজার বাবা এনামুল হক বলেন, বড় মেয়ে লিমা আক্তার পড়াশোনা করতে গিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছে। এতে আমার মান সম্মানের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। ছোট মেয়ে লিজা ২০২১ সালে এসএসসি পাশ করেছে। লেখাপড়াতেও ভালো ছিল। মেয়েটি সুন্দর হওয়ায় ছেলেরা বিরক্ত করত। এ কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ করে বাড়িতে রেখে বাড়ির বাইরে বের হতে দেইনি। আমি সকালে তালা দিয়ে বাইরে যাই আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তালা খুলে দেই। বর্তমানে মেয়েটি অসুস্থ। পুলিশ ও স্থানীয়রা এসে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে মেয়েটিকে দেখেছে। সবার সামনে মেয়েটি কথাবার্তা স্বাভাবিক বলেনি। তবে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য না। পুলিশ মেয়েটিকে অবমুক্ত করে দ্রুত চিকিৎসা করার কথা বলে গেছেন।

আক্কেলপুর থানার উপ-পরিদর্শক গনেশ চন্দ্র বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ওই বাড়িতে প্রবেশ আমরা প্রবেশ করি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে একটি আবদ্ধ ঘরে মেয়েটিকে দীর্ঘদিন আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। দীর্ঘদিন আবদ্ধ থাকায় মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে অবমুক্ত করে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য তার বাবাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর