দেখতে অন্যান্য কুকুরের চেয়ে কিছুটা আলাদা। মুখটা অনেকটা শেয়ালের মতো, কান লম্বা। দুধ ভাত আর মাছ, মাংস এদের পছন্দের খাবার। সাদা, কালো, লালসহ বিভিন্ন রং এর এসব কুকুরের নাম রয়েছে বিশ্বজুড়ে। জন্ম থেকেই শিকারের কাজে পারদর্শী এই কুকুর শিয়াল, বনবিড়াল, বাঘদাস শিকারে খুবই পারদর্শী। চোর-ডাকাতরা তো নাম শুনলেই আঁৎকে উঠে। শিকার এবং পাহাড়ায় খুবই পারদর্শী বিধায় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ডগ স্কোয়াডসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই’র ডগ স্কোয়াডেও শোভা বাড়াচ্ছে এই ব্যতিক্রমী কুকুর।
অপরাধীকে সুনিপুণ কায়দায় তাড়া করে আয়ত্তে আনা কিংবা গন্ধ শুঁকে রহস্যের সন্ধান দেওয়াতেও জুড়ি নেই তার। প্রভুভক্তি, নিজের চতুরতা ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের বিরল প্রজাতির এই গ্রে-হাউন্ড জাতের কুকুর উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে হয়ে উঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থের অভাব এবং সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় এই কুকুরের লালন-পালনের পরিধিও অনেক ছোট হয়ে এসেছে। একসময় শখের বশে বা আভিজাত্যের জন্য লালনপালন করলেও বিখ্যাত এই প্রজাতির কুকুর আজ বিলুপ্তির পথে।
বিজ্ঞাপন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে এই কুকুরের অবস্থান সম্পর্কে দুইটি মিথ চালু আছে এই জনপদে। কেউ বলেন- বহুকাল আগে সরাইলের এক দেওয়ান তার হাতি নিয়ে সরাইল পরগনা থেকে ভারতের কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক বাড়িতে একটি কুকুর দেখতে পান তিনি। অনেক বলার পরও কুকুরের মালিক দেওয়ানকে কুকুরটি দিতে রাজী না হওয়ায় তিনি তার হাতির বিনিময়ে কুকুরটি নিয়ে আসেন। সেই কুকুর এক সময় কয়েক হাত বদল হয়ে তার দাদা গঙ্গাচরণ রবিদাসের কাছে চলে আসে। আর শিয়ালের সঙ্গে মিলনের ফলে বর্তমান এই জাতের কুকুরের সৃষ্টি। আবার কেউ বলেন, সরাইলের এক দেওয়ান একবার হাতি নিয়ে শিকারের জন্য বনে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল তার প্রিয় মাদী কুকুরটিও। এক সময় হারিয়ে যায় কুকুরটি। পরে বনে অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখতে পান এটি একটি বাঘের সঙ্গে মিলন করছে। বাঘের সঙ্গে মিলনের ফলেই শিকারি প্রকৃতির এই গ্রে-হাউন্ড কুকুরের উৎপত্তি।
জানা গেছে, এক সময় সরাইলের বহু বাড়িতেই এই কুকুর রাখা হতো বাড়ি পাহাড়ায়। এর সুনাম ছড়িয়ে পড়লে তখনকার সময়ে শৌখিন লোকজন নিজেদের বাড়ি পাহারা বা শিকারের কাজের জন্য এসব কুকুর সংগ্রহ করতেন। ক্রমেই এর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে উপমহাদেশ জুড়ে। দেশের পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এই কুকুর নিতে আসে। বিদেশ থেকেও শৌখিন লোকজন প্রতিবছরই এখানে আসেন কুকুর কিনতে। কিন্তু বর্তমানে আগের মতো এখানে এই কুকুর পাওয়া যায় না। মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক কষ্ট করে কায়ক্লেশে এই কুকুর পালন করছেন। তাই সরাইলের এসব গ্রে-হাউন্ড কুকুরের দামটাও বেশি। কিন্তু কালের আবর্তে আজ সবই অতীত। এক একটি বাচ্চা কুকুর ২০/২৫ হাজার আর বড় কুকুর ৬০/৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আগে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে কুকুর পালন করলেও বর্তমানে উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে এই কুকুর পালন করা হয়।
সরজমিনে কুকুর পালনকারী উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের অজিত লাল দাসের বাড়িতে যেতেই শুনা যায় কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক। নাম ধরে ডাকতেই ছেড়ে রাখা সব কুকুর চলে আসে গৃহকর্তা অজিত লাল রবিদাসের সামনে।
অজিত লাল দাস বলেন, টাইগার, মধু, পপি, কালী, লালী, টমি, কালা সহ বিভিন্ন নাম আছে এই কুকুরদের। জন্মের পর তাদের আচরণ অনুযায়ী নাম রাখা হয়। বর্তমানে তার বাড়িতে ছোট বড় মিলিয়ে ২০টি কুকুর আছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ৫টি ছোট বাচ্চার জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন ২ লিটার দুধ। তাছাড়া ভাল দাম পেতে মাংসসহ উন্নতমানের খাবারও দিতে হয় এদেরকে। ৩ থেকে ৫ মাসের একটি বাচ্চা কুকুর ২০/২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আর বড় কুকুরের দাম উঠে ৬০/৬৫ হাজার টাকায়।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, নিজে যে ঘরে থাকেন সেই ঘরেই কুকুর রাখেন। প্রায়ই কুকুর নিয়ে যেতে চোর ডাকাত হানা দেয় তার বাড়িতে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিক মত খাবার দেওয়া তার জন্য কষ্ট হয়ে পড়ে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্য পাওয়া গেলে এই কুকুরের প্রজাতি ধরে রাখা সম্ভব। নতুবা এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে বিশ্বখ্যাত এই গ্রে-হাউন্ড কুকুর।
উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের নাহার মিয়া বলেন, বহু আগে দাদার কাছে শুনেছি এই কুকুরের সরাইলে আগমন উপলক্ষ্যে। এই কুকুর আমাদের সরাইলকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে। সরকারের উচিত ব্যতিক্রমী এই প্রজাতির কুকুরকে রক্ষা করা।
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, সরাইলের ঐতিহ্যের কথা বলতে গেলে বিখ্যাত গ্রে-হাউন্ড কুকুরকে বাদ দেওয়া যাবে না। দেশ বিদেশে এই কুকুর সরাইলের পরিচিতি বহন করে। সরাইলে এই কুকুরের একটি প্রজনন কেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রতিনিধি/এজে

