শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস স্মরণ করলেই ভেসে ওঠে শহীদ আবু সাঈদের নাম। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন। ওইদিন পুলিশের গুলি চালানোর সময় রাজপথে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকেন আবু সাঈদ।
এই ছবি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেশ জুড়ে রাস্তায় নেমে আসেন মানুষ। আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র জনতার আন্দোলনে। রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন ঘটে তৎকালীন সরকারের। আর ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে নতুন নেতৃবৃন্দের। ছাত্র জনতা ঐক্যবদ্ধ লড়াই ও আত্মত্যাগ গোটা বিশ্বকে চমকে দেয়।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের থেকে সরকার পতনের আন্দোলন রূপ নেয় মূলত রংপুরের আবু সাঈদের বুকে গুলি এবং রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে।
১৬ জুলাই আন্দোলনে দুই হাত প্রসারিত করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে বুক পেতে দিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র শহীদ আবু সাঈদ। তিনি এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকেই। আজ জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ এর প্রথম শাহাদাতবার্ষিকী পালনে সরকারি বেসরকারি রাজনৈতিক সংগঠন থেকে নেওয়া হয়েছে দিনব্যাপী কর্মসূচি।
রংপুরে ১৬ জুলাই ২০২৪ এ যা ঘটেছিল:
কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের মাঝে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বলায় সারাদেশে নতুন করে ফুঁসে উঠে ছাত্রসমাজ। সারাদেশের মতো রংপুরেও ১৬ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে দুপুরে বেরোবির কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শহরের লালবাগ এলাকায় থেকে ক্যাম্পাসের দিকে যান। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। সেই সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে চলমান আন্দোলনে পুলিশের অ্যাকশন শুরু হয়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ লাঠি হাতে নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক উঁচিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দুই হাত প্রসারিত করে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পুলিশের কয়েকদফা বুলেট গিয়ে আবু সাঈদের বুকে লাগে। একপর্যায়ে লুটিয়ে পরেন মাটিতে। পরে সহপাঠিরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃতু ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। তৎকালীন চলমান আন্দোলনে কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হলেও প্রথম নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে রংপুরে।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরলে রংপুরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠে এবং রাজপথে নেমে পরে। সবাই ছুটতে থাকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। অন্যদিকে আবু সাঈদের লাশ নিয়ে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ নিয়ে নগরীর প্রধান সড়ক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে ধরলে পুলিশ বাধা প্রদান করেন। এক পর্যায়ে পুলিশ আবু সাঈদের লাশ জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে তাদের গন্তেব্যে চলে যায়। এরপরে আন্দোলনে আরো গতি বাড়ে সারাদেশের মতো রংপুরে। সন্ধ্যার আগেই পুরো নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দখলে নেন আন্দোলনকারীরা। এরপরেই ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা।
ভিসির বাড়িতে আগুন: চলমান আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের নিহত হওয়ার ঘটনায় পুরো রংপুর নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক দখলে নেন আন্দোলনকারীরা। এরপর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন তারা। পরে ভিসির বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে থাকা সাংবাদিকের কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। সেদিনের সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিক, ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীসহ শতাধিক আহত হন।
আবু সাঈদের মরদেহ গুম: সেদিন আবু সাঈদের মরদেহ পুলিশ আড়াই ঘণ্টা গুম করে রেখেছিল। সেই সঙ্গে রাতেই লাশ দাফনের জন্য প্রবল চাপ তৈরি করেছিল পরিবারের ওপর। এই দাবি করেছেন নিহতের বড়ভাই রমজান আলী। তিনি বলেন, ফজরের পূর্বে লাশ বাড়িতে নিয়ের আসার পর ওইদিন রাতেই ইউএনও, ওসি এবং আওয়ামী লীগ নেতারা বাড়িতে গিয়ে লাশ দাফনের জন্য কবর খোড়ার চাপ দিয়েছিল। তখন তারা অসহায় হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তারা পরের দিন সকাল ৭টার মধ্যেই দাফন এবং মসজিদে জানাজা করার জন্য নির্দেশ দেন। তখন আমরা আরও ভয় পেয়ে যাই। আমি বলি, কবর খনন করতেই তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। তখন তারা আমাদের কবর খোঁড়ার বিষয়টি দেখভাল করে। পরে ছাত্র ভাইদের সহযোগিতায় মাদরাসা মাঠে জানাজা করেছি এবং ১১টায় দাফন করেছি। এ সময় ছাত্রদের মাত্র ১৫ মিনিট সময় দিয়েছিল পুলিশ।
আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা: কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলা করেছেন পুলিশের পক্ষ থেকে অন্যটি করেছেন তার পরিবারের পক্ষ থেকে।
পুলিশ বাদী: আবু সাঈদ নিহতের ঘটনার ১৭ জুলাই রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তাজহাট থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা হয়। বাদী তাজহাট থানার (বেরোবি) পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই বিভূতি ভূষণ রায়। পেনাল কোডের (১৪৩/১৮/৬/৩৩২/ ৩৩৩/৩৫৩/৩৭৯/৪৩৫/ ৪২৭/৩০২/৩৪) ধারায়। মামলার বিবরণে উল্লেখ রয়েছে, বেআইনি জনতা সাধারণ/মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করে গুরুতর জখম, চুরি, ভাঙচুর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ ছাত্রকে হত্যা করে অপরাধ করা হয়েছে। আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ না থাকলেও এতে বলা হয়, এরা উচ্ছৃঙ্খল ২-৩ হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্ত। তাদের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির সমর্থিত নেতাকর্মীও রয়েছে। পুলিশের এই প্রতিবেদনে মামলাকে সাজানো নাটক বলে অভিহিত করেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও আবু সাঈদের পরিবার।
আবু সাঈদের পরিবারের মামলা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় আওয়ামী সরকারের পতনের পর ১৮ আগস্ট মামলা করেন তার বড় ভাই রমজান আলী। ওই মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৩০-৩৫ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন তৎকালীন পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, রংপুরের ডিআইজি আব্দুল বাতেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান, উপপুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন, সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফুজ্জামান, সহকারী পুলিশ কমিশনার ইমরান হোসেন, থানার ওসি রবিউল ইসলাম, পুলিশের এএসআই সৈয়দ আমীর আলী ও সুজন চন্দ্র রায়কে। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক শামিম মাহফুজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদ মণ্ডল, গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা রাফিউল হাসান রাসেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতিভূষণ, বেরোবি ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেনকে আসামি করা হয়েছে। বর্তমানে আবু সাঈদের মামলাটি ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে।
আবু সাঈদের ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে যত কর্মসূচি: কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম শহীদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রশাসন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন: কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম শহীদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বেরোবি প্রশাসন। সেই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরি রফিকুল আবরার, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, বীরপ্রতীক। অনুষ্ঠানে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন থাকবেন প্রধান অতিথি। এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. তানজীমউদ্দীন খান।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি: কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম শহীদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে রংপুরে আসবেন এবি পার্টির কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকীসহ অন্যান্য রাজননৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
এ বিষয়ে শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন জানান, আমার ছেলে জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ। অথচ এক বছরে হয়ে গেলো, সকল আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। সরকারের কাছে বলবো, যতদ্রুত সম্ভব আমার ছেলেকে যারা মেরেছে, প্রকৃত আসামিদের বিচার নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে দেশের জন্য যারা শহীদ হয়েছে তাদের হত্যাকারীদেরও বিচার করা।
প্রতিনিধি/টিবি

