রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পরিবারহীন ১২ বন্ধুর এসএসসি পরীক্ষায় জয়, স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর

জেলা প্রতিনিধি, পঞ্চগড়
প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০২৫, ১১:১১ এএম

শেয়ার করুন:

পরিবারহীন ১২ বন্ধুর এসএসসি পরীক্ষায় জয়, স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর

জীবনের শুরুটা কাঁটায় ভরা হলেও, এবার নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে পরিবারহীন ১২ কিশোর। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে তারা সবাই সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায়।

তারা কেউ মা-বাবাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছে, কেউ বা ফেলে যাওয়া ভবঘুরে জীবনের তিক্ততা নিয়েই বড় হয়েছে কোনো শিশু সদনে। কিন্তু জীবনের দুঃখ তাদের দমাতে পারেনি।


বিজ্ঞাপন


thumbnail_IMG-20250710-WA0045

এই ১২ জন কিশোর এখন শুধু একটি পরিচয়ে পরিচিত- তারা সবাই এবারকার এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে। কেউ জিপিএ-এ, কেউ পেয়েছে প্রথম বিভাগ। সাফল্যের এই আনন্দে ভরে উঠেছে এতিমখানা ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর আঙিনা।

এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই জানিয়েছে, তারা ভবিষ্যতে শিক্ষক, চিকিৎসক কিংবা পুলিশ অফিসার হতে চায়। তাদের স্বপ্ন-নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজে কিছু একটা করে দেখানো

অনিশ্চিত পথের জীবন থেকে ওঠে আসা এই ১২ জন কিশোর হলেন- কবির হোসেন হৃদয়, সাব্বির হোসেন, সফিকুল ইসলাম, পারভেজ রানা, আব্দুল মজিদ, সুজন আলী, রাকিবুল হাসান, বরজুল রহমান বায়েজিদ, তাপস চন্দ্র রায়, জিহাদ মিয়া, আল আমিন ও হৃদয় কুমার।


বিজ্ঞাপন


জানা যায়,তারা ছোট থেকে তারা বেড়ে ওঠেছেন পঞ্চগড়ের ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে'। এ বছর পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তারা। এসএসসির সফলতায় তাদের যেন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, চোখে নতুন জীবন সাজানোর স্বপ্ন। তাদের এই অর্জন প্রমাণ করেছে- ভালোবাসা, যত্ন আর সুযোগ পেলে যেকোনো শিশুই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এখন তাদের মতো স্বপ্ন বুনছেন নগরীতে থাকা আরো ১৬০ জন মা-বাবাহীন শিশু।

আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। অনাথ, ছিন্নমূল এবং বঞ্চিত ও হারিয়ে যাওয়া পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি।

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ- ৪ দশমিক ৯৬ অর্জন করেছেন কবির হোসেন হৃদয়। সে খুব ছোটবেলায় বাবা রিয়াজ ও মা রোকেয়ার বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকেই অবহেলার শিকার হয়ে পড়ে সে। এক পর্যায়ে মাত্র ৫ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে পালিয়ে এসে পথশিশুর পরিচয়ে জীবন শুরু করেন। ২০১৪ সালে কোনো এক রেলস্টেশন থেকে সমাজকর্মীর মাধ্যমে এই শিশু নগরীতে ঠাঁই হয় তার। বাড়ি ‘নারায়ণগঞ্জ'- এটুকুই মনে আছে হৃদয়ের। প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফেরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার।

thumbnail_IMG-20250710-WA0040

এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৮২ পাওয়া আব্দুল মজিদ জানান, লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের তুষভান্ডারে তার বাড়ি। বাবা-মা, পরিবার সবই আছে তার। খুব ছোটবেলায় পরিবার থেকে হারিয়ে গেলে ঠাঁই হয় এখানে। পরবর্তীতে পরিবারের সন্ধান মিললেও এখানেই থেকে যান। তিনি বলেন, শুরুর দিকে খারাপ লাগলেও এখন ভালো আছি। এটাই আমার বড় ঠিকানা। এসএসসি পাশ করব- এটা ছিল স্বপ্নের মতো। পাশ করেছি, এই অনুভূতি বোঝাতে পারব না। পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু করতে চাই।

সাব্বির হোসেনের রেজাল্ট জিপিএ-৪.৭৫। খুব ছোটবেলায় পরিবার থেকে নিখোঁজ হওয়া এই কিশোর জানেনা তার বাড়ি কোথায়। তার শুধু মনে আছে- বাবার নাম মারুফ, মায়ের নাম ছবি আক্তার। তিনি বলেন, কখনও কারও আদর স্নেহ পাইনি। আত্মীয় স্বজন কেউ আছেন কি-না তাও জানি না। এই শিশু নগরীই আমাদের ঠিকানা। এখানকার স্যারেরাই আমাদের অভিভাবক।

এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ- ৪.৫০ পাওয়া সফিকুল ইসলামের মায়ের নাম সুখী আক্তার। কিন্তু মা-ছেলে দুজনই সুখহীন। সফিকুলও জানে না তার বাড়ির ঠিকানা। শুধু মনে আছে- বাবার নাম আব্দুস সালাম, মা সুখী আক্তার। মা-বাবাকে খুঁজে পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা সফিকুলের। মা সুখী আক্তারকে দেখতে প্রকৃত সুখী হিসেবেই।

একই রকম গল্প জিপিএ- ৪.২১ পাওয়া পারভেজ রানারও। শুধু মনে আছে- তার বাবার নাম হারুন, মা পারুল। খুব ছোটবেলায় পরিবার থেকে নিখোঁজ হলে সমাজকর্মীর মাধ্যমে এখানে ঠাঁই হয় তার।

সুজন আলী পেয়েছে জিপিএ- ৪.১৪। তিনি জানান, বাবা আব্দুল হামিদ ও মা আম্বিয়া খাতুনের সঙ্গে কোনো এক রেলস্টেশনে গিয়েছিলেন। সেখানে ভিড়ের মধ্য থেকে হারিয়ে যান সে। তার শুধু মনে আছে ভৈরব কিশোরগঞ্জে আমাদের বাড়ি। বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ে। জানি না কখনও তাদের কাছে ফিরে যেতে পারব কি-না!

এবারের এসএসসির জিপিএ-৩.৬৮ পাওয়া তাপস চন্দ্র রায় কখনই বাবাকে দেখেননি। তার জন্মের পর পরই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন বাবা সুকুমার রায়। বেঁচে আছেন কি-না তাও জানেন না। শুধু জানেন তাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে, মায়ের নাম শিঞ্জিবালা। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তার।

আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী কর্তৃপক্ষ জানান, বিভিন্ন বয়সি ১৬০ জন শিশু রয়েছে এখানে। এই ১২ জনের মতো প্রত্যেকেরই গল্প হৃদয়বিদারক। অনেকেই রয়েছে পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া, জানে না নিজের পরিচয়। আবার কারও বাবা নেই, কারও মা নেই। এমনও আছে কারও বাবা-মা কেউ নেই। তবে এখানে স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকছে তারা। সময়মতো পড়ালেখা, বাকী সময় খেলাধুলা আর আনন্দ বিনোদনে পার করে তারা।

শিশু নগরীর শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, শিশুদেরকে এখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর তারা মাধ্যমিকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়। সদ্য এসএসসি পাশ করা ১২ জনও এখান থেকেই প্রাথমিক শেষ করেছিল। শিশুদের যাবতীয় খরচবহনসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে ঢাকা আহছানিয়া মিশন।

আরও পড়ুন

এসএসসিতে যমজ দুই ভাইয়ের অবাক করা রেজাল্ট, জিপিএ ও প্রাপ্ত নম্বরও একই

শিশু নগরীর কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান বলেন, বিভিন্নভাবে বঞ্চিত শিশুদের এখানে ঠাঁই হয়। শুরুর দিকে শিশুরা থাকতে না চাইলেও একটু বড় হওয়ার পর তারা অনেক কিছু বুঝতে পারে। তারা বুঝতে পারে এটাই তাদের মূল ঠিকানা। এখানে শিশুরা নিজের বাড়ির মতই থাকে, পড়ালেখা করে। এ পর্যন্ত এখানে থাকা ২৪ জন এসএসসি পাশ করেছে।

তিনি আরও বলেন, আহছানিয়া মিশনের উদ্দেশ্য হলো- এই শিশুদের ১৮ বছর পূর্ণ হলে কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সদ্য এসএসসি পাশদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে ঢাকা আহছানিয়া মিশন।

এ বিষয়ে আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর সেন্টার ম্যানেজার দিপক কুমার রায় বলেন, অন্ধকারে পা বাড়ানো শিশুদের আলোর পথে নিয়ে আসে আহছানিয়া মিশন। তাদের সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এই শিশু নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ১২ জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সবার ভালো ফলাফল- এটা একটা বড় অর্জন বলে মনে করি। এখানে থাকা অন্য শিশুরাও ক্রমান্বয়ে সুফল বয়ে আনবে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর