জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঠিক থাকা সত্ত্বেও চাহিদামতো ঘুষ না দিলে কাগজপত্র গ্রহণই করা হয় না। ঘুষের টাকা দিলেও মাসের পর মাস ভূমি অফিসে ঘুরতে হয় সেবা প্রার্থীদের। এছাড়া অনলাইনে সার্ভার সমস্যার অজুহাতে দেখিয়ে সেবা গ্রহণকারীদের হয়রানির রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এ ছাড়া চাহিদামতো টাকা না দিলে সরকারি খাসজমিও নিয়মমাফিক বন্দোবস্ত দেওয়া হয় না। মোট কথা টাকা ছাড়া কোনো কাজই হয় না গাজীপুরে বেশির ভাগ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। ভুক্তভোগী ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ, গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক সরকারি অফিসে নীতি নৈতিকতার কিছুটা পরিবর্তন হলেও জেলার ইউনিয়ন ভূমি অফিস এগুলোর অনিয়ম রয়ে গেছে আগের মতই। টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না এখানে। তবে স্থানীয় জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ঘুষ দুর্নীতি দমনে কাজ করছে প্রশাসন । শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন অনেক কর্মকর্তা।
![]()
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে জেলার শ্রীপুর, সদর উপজেলা, কালীগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঘুরে দেখা গেছে, নামজারি, জমা ভাগ, খাজনা আদায়, মিস মোকাদ্দমাসহ নানা কাজে ভিড় করেছেন সেবা প্রার্থী সাধারণ মানুষ। এসব মানুষের অনেকেই জানেন না সরকার নির্ধারিত ফি ও সিটিজেন চার্টারের খবর। ফলে ভূমি অফিসের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের যোগা সাজসে দালাল ও টাউটদের পাল্লায় পড়েন গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষ। একেকটা খারিজ ও নামজারিতে শ্রেণিভেদে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৩০-৪০ হাজার পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়। এসব টাকার ভাগ পান ভূমি অফিসের বড় কর্তারাও। এছাড়া বিবদমান এক পক্ষের টাকা নিয়ে অপর পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উধাও করে দেওয়া, সেবা প্রার্থীদের নির্দিষ্ট সময়ে সেবা না দেওয়া, অযথা সময়ক্ষেপণ করাসহ নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
![]()
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, টাকা দিলে ছেঁড়া দলিলেও কাজ হয়। আর টাকা না দিলে কাগজপত্র নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখা হয় মাসের পর মাস। এখানে ঘুষ নিয়ে কাজ করা একদম ওপেন সিক্রেট ব্যাপার । শুধু তাই নয়, চাহিদা মাফিক টাকার মধ্যে কম টাকা পরিশোধ করা হলেও ঘোরানো হয়, হয়রানি করা হয়।
বাসন ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সেবা নিতে এসেছেন একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. হান্নান সরকার। তার জমির খারিজ ও জমির পরিমাণ সংশোধনের জন্য (স্মারক নং ৪৩৩ তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। আবেদনের পর কাগজ পত্র এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানোর কথা। সেখানে খোঁজ নেয়ার পর তারা জানান, তার নামে ভূমি অফিস থেকে কাগজ পাঠানো হয়নি। টাকা না দেওয়ায় আজ অবধি সেই কাগজ পাঠাননি ভূমি অফিসের লোকজন। কিন্তু ভূমি অফিসে গেলে বলে কাগজ পাঠানো হয়েছে। এইভাবে দুই অফিসে ঘুরে ঘুরে হয়রানি হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন ওই শিক্ষক।
বিজ্ঞাপন
![]()
অভিযোগ রয়েছে, শ্রীপুর উপজেলার সিংহশ্রী ইউনিয়নের পেলাইদ গ্রামের কৃষক শহীদুল ইসলামের। এক বিঘা জমির নামজারি (খারিজ) করতে যান সিংহশ্রী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। এ জন্য উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাজ উদ্দিন তার কাছে ৮ হাজার টাকা দাবি করেন। শহীদুল ৪ হাজার টাকা দেওয়ার পর টাকা নিয়ে আবেদন গ্রহণ করেন তিনি। এরপর দীর্ঘ দুই বছর পার হলেও কাগজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। যোগাযোগ করলে সার্ভার সমস্যাসহ নানা অজুহাত দেখানো হয়।
![]()
হয়রানির অভিযোগ এনে স্থানীয় বাসিন্দা গোলাম মোহাম্মদ বলেন, আমি পর্চা উঠানোর জন্য গাজীপুর থেকে ৪০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এই ভূমি অফিসে এসেছি। এসে দেখি ভূমি কর্মকর্তা অফিসে নেই। এখন আমার পরিশ্রম, অর্থ দুটোয় গেল। এই অফিসে টাকা ছাড়া কোন কাজ হয় না।
তিনি বলেন, উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে বারবার অনুরোধ করলেও তিনি অফিসের কক্ষে তালা লাগানো বলে জানিয়েছেন ।
![]()
কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সামনে বটগাছের নিচে বসে আছেন পানজোরা গ্রামের বৃদ্ধ রুহুল আমিন। তার সাথে রয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন বাসিন্দা।
রুহুল আমিন বলেন, তার জমি নামজারি (খারিজ) করতে ছয় মাস আগে কাগজ পত্র জমা দিয়ে আবেদন করেছেন। এজন্য তিনি ৬ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, শুধু সরকার নির্ধারিত ফি’তে কাজ করতে গেলে আমার কাজ হবে না বলে এখানকার লোকজন জানিয়েছে। আর সরকারি ফি সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না’।
![]()
একই উপজেলার নিয়াজ আলী বলেন, ‘আমি খারিজ করতে আসলে আমার কাছে ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। আমি তাদের ১০ হাজার টাকাই দিয়েছি। তারপরও চার মাস ধরে তারা আমাকে ঘুরাচ্ছে। আমরা আসলে বুঝি না কত টাকা লাগব। তাদের চাহিদা মতো টাকা দিছি কিন্তু তারা কোনো রসিদ দেননি।’
অভিযোগ অস্বীকার করে নাগরী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা সোলায়মান সরকার বলেন, কাগজপত্র সঠিক থাকলে তার অফিসে কোনো টাকা পয়সা লাগে না। তার অফিসে কোনো দালাল নেই।
![]()
এদিকে, একই চিত্র দেখা গেছে সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। সেখানে সরেজমিনে গেলে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে কেটে পড়েন সেখানে থাকা দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীরা।
![]()
সেখানে কথা হয় নয়াপাড়ার বাসিন্দা মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, জমি খারিজ করতে তিন মাস আগে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত খারিজ বুঝিয়ে দেয়নি। আজ আসতে বলেছে, দেখি কী হয়’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক বাসিন্দা বলেন, এই অফিসে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। মানুষ নিরুপায়, তাদের টাকা দিতেই হবে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা সরোয়ার হোসেন।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( রাজস্ব) মোহাম্মদ কায়সার খসরু বলেন, ভূমি সেবাকে জনগণের কাছে সহজতর ও ভোগান্তি বিহীন করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়, ভূমি সংস্কার বোর্ড ও জেলা প্রশাসন আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটালাইজড করা। এটি করতে পারলে ঘরে বসে মানুষ হয়রানি ছাড়া কাজ করতে পারবেন। কিন্তু বিদ্যমান ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্যে বিশেষ করে গাজীপুরের অবস্থা জটিল। এজন্য মানুষ এখনও সেবা প্রাপ্তির জন্য তৃতীয় পক্ষের দ্বারস্থ হন এবং হয়রানির শিকার হন। এজন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সারাদেশে ভূমি সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এটি করা গেলে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে নির্দিষ্ট কাজ করা যাবে। এতে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে বলে আশা করি। আর আমরা যখন যে অভিযোগ পাচ্ছি তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখানে গত ৬ মাসে অন্তত চারজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
প্রতিনিধি/এসএস

