মৌলভীবাজারের ‘পান আপ্যায়ন’ একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা। সেখানকার বাড়িতে কোনো অতিথি এলে তাকে পান দিয়ে বরণ করা হয়। এছাড়াও জন্মদিন, বিয়ের আয়োজন ও বিভিন্ন পালা-পার্বণে প্রধান অনুষঙ্গ পান-সুপারি। আর ‘বাংলা পান’ স্থানীয়দের কাছে খুবই প্রিয়।
মৌলভীবাজারের বাংলা পান জেলার চাহিদা মিটিয়ে সিলেটসহ লন্ডনেও রফতানি হতো। এক সময় গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তিশালী খাত ছিল বাংলা পানের বরজ। ছন, বাঁশ ও বেতে তৈরি বরজে সারি সারি সবুজ পানের পাতায় ভরে থাকত চাষিদের স্বপ্ন। কিন্তু এখন সেই চিত্র বদলে গেছে। উপকরণ সংকট, শ্রমিকের অভাব ও কৃষি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতিতে অনেক চাষি বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন পান চাষ। কেউ পেশা বদল করছেন, পান চাষে আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ঐতিহ্যবাহী এ খাত হারাতে বসেছে তার স্বকীয়তা।
বিজ্ঞাপন
![]()
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌলভীবাজারের মনু নদের তীরজুড়েই একসময় বাড়ৈ সম্প্রদায় পানের বরজ তৈরি করে পান চাষ করতেন। পর্যায়ক্রমে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চাষিরা পান চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বর্তমানে পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে জেলার রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলার মনু নদের তীরবর্তী এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের কিছু চাষি বরজ তৈরি করে এখনও পান চাষ করছেন।
পান চাষের সঙ্গে জড়িতরা জানান, বাংলা পানের বরজ তৈরির উপকরণ ছন, বাঁশ, বেত ও শ্রমিক সংকটের কারণে অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছেন পান চাষ। পান চাষ ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন তারা। এ ছাড়া কৃষি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতা ও সরকারি প্রণোদনার অভাবেও পান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা।
![]()
বিজ্ঞাপন
কৃষি বিভাগ বলছে, এ পর্যন্ত বাংলা পান চাষের জন্য কোনো প্রকল্প নেই আমাদের হাতে। জেলায় প্রায় ২৫ একর ভূমিতে বাংলা পান চাষ হয়ে থাকে। নিজ উদ্যোগেই চাষ করেন তারা। আগে বাংলা পান চাষে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, রাজনগর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫ শতাধিক পরিবার জড়িত ছিল। বর্তমানে সংখ্যা কমে শতাধিক হয়েছে।
জেলার পান চাষিরা বলেন, সরকার কৃষকদের জন্য সারাদেশে বিনামূল্যে সার, বীজ ও কীটনাশক বিতরণ করলেও পান চাষিরা তা পান না। কৃষি বিভাগ থেকে যদি পান চাষে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিয়ে উৎসাহিত করতেন তাহলে চাষিরা আগ্রহ হারাতেন না।
রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের টুপির মহল গ্রামের কোলনিশি দে বলেন, অতীতে আমাদের এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পান চাষ হতো। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রফতানি করা হতো। কিন্তু নানাবিধ সমস্যায় এখন পানের চাষ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
![]()
বাংলা পানের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এখনও পান চাষ করছেন জানিয়ে কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের কুড়িগ্রামের সুব্রত কর বলেন, পান চাষ করে সংসারের খরচ চলত। কিন্তু বর্তমানে ছন, বাঁশ ও শ্রমিক না পাওয়ায় বরজ তৈরি করতে অনেক কষ্ট হয়। ৩ বছর মেয়াদের ৮ শতকের ভূমিতে একটি বরজ তৈরি করতে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিবছর মেরামত খরচ হয় ৮-১০ হাজার টাকা। লাভ হয় ৩০ হাজার টাকা।
একই ইউনিয়নের চকসালন গ্রামের বাবুল দত্ত বলেন, একসময় আমাদের গ্রামের শতভাগ মানুষ পান চাষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিগত ৫-৭ বছরে পানের দাম কমেছে। বর্তমানে ১৫-১৬ ভাগ মানুষ পান চাষ করছেন। সরকার উদ্যোগ নিলে হয়ত আবার পান চাষে মানুষ ফিরে যাবে।
![]()
শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের তুষ্টি দেব বলেন, আগের তুলনায় পান কম উৎপাদন হয় এবং আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। যার ফলে পান চাষে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, মৌলভীবাজারে বাংলা পানের চাষ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে খাসিয়া পানের চাষ বাড়ছে। বাংলা পান চাষিদের সহায়তার জন্য আমাদের কাছে সরকারি কোনো প্রণোদনা বা প্রকল্প আসেনি। আমরা পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকি। কোনো সুযোগ এলে আমরা বাংলা পান চাষিদের পাশে দাঁড়াব।
প্রতিনিধি/এসএস

