রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইমামতি না করেও জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম ওলামা দল নেতা, সমালোচনার ঝড়

জেলা প্রতিনিধি, নেত্রকোনা
প্রকাশিত: ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ইমামতি না করেও জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম ওলামা দল নেতা, সমালোচনার ঝড়
সম্মাননা অনুষ্ঠানে জসিম উদ্দিন। তার ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত।

জীবনে কখনও কোনো মসজিদে ইমামতি করেননি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার ওলামা দল নেতা হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন। তবুও তিনি হয়েছেন জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম।

বিষয়টি নিয়ে এলাকায় সমালোচনার ঝড় বইছে। এতে অনেক আলেম- ওলামা ও ইমামরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।


বিজ্ঞাপন


গত ২৯ জুন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানে জসিম উদ্দিনকে নেত্রকোনা জেলার শ্রেষ্ঠ ইমামের সম্মাননার পাশাপাশি ক্রেস্ট, সনদ ও সম্মাননা চেক দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। এছাড়া ধর্ম সচিব একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ) আ. ছালাম খান উপস্থিত ছিলেন।

1000095298

বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। একজন ইমাম না হয়েও কীভাবে তিনি জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম হলেন—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বমহলে।


বিজ্ঞাপন


হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন তালুকদার বারহাট্টা উপজেলার বিক্রমশ্রী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত মসজিদ ভিত্তিক সহজ কুরআন শিক্ষা বিভাগের উপজেলা শাখার মডেল কেয়ার টেকার হিসাবে কর্মরত।

জসিম উদ্দিন উপজেলা ওলামা দলের সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি উপজেলা হেফাজতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছে। এছাড়াও ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ পরিষদ’ একটি মানবাধিকার সংগঠনের বারহাট্টা উপজেলা শাখার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি

স্থানীয় একাধিক মসজিদের ইমাম ও ধর্মীয় ব্যক্তিরা বলেন, এটা ধর্মীয় দায়িত্ব ও ইমামতির মর্যাদার প্রতি অবমাননা। একজন প্রকৃত ইমাম যারা দিনের পর দিন ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, তাদের উপেক্ষা করে ইমাম না এমন একজন রাজনৈতিক পরিচয়ধারীকে এই সম্মাননা দেওয়া দুঃখজনক।

নেত্রকোনা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচনে জেলার ১০টি উপজেলা থেকে ২০ জন করে মোট ২০০ জন ইমামের তালিকা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এতে জসিম উদ্দিন নিজেকে বারহাট্টা উপজেলার বিক্রমশ্রী জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে উল্লেখ করেন।  চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি কার্যালয়ের সাবেক উপ-পরিচালক শফিকুর রহমান সরকার যাচাই বাছাই করে জসিম উদ্দিনসহ তিনজনকে শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচন করা হয়। পরে তালিকা বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়। বিভাগ থেকে যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঢাকা কার্যালয়ে। শেষে গত ২৯ জুন রাজধানীতে ধর্ম উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সম্মেলনের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ ইমামদের সম্মাননা, ক্রেস্ট ও চেক দেওয়া হয়।

জানা গেছে, জেলায় সহস্রাধিক ইমাম রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত।

thumbnail_1000095297

সম্মাননা পাওয়ার পর ক্রেস্ট প্রাপ্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন জসিম উদ্দিন। তখনই বিষয়টি জানাজানি হয়। এতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানান অনেকে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, বারহাট্টা উপজেলার বিক্রমশ্রী জামে মসজিদে ২০১৪ সাল থেকে ইমামতি করেন মাওলানা রফিকুল ইসলাম। যদিও তালিকায় ওই মসজিদের ইমাম দেখানো হয়েছে জসিম উদ্দিনকে।

মসজিদের ইমাম মাওলানা রফিকুল ইসলাম বলেন, দুই যুগের বেশি সময় ইমামতি করেও তালিকায় আমাদের নাম নেই। জসিম উদ্দিন কোথাও ইমামতি করেন না। অথচ যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাকে শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচিত করা হয়েছে। এটা দুঃখজনক। পেশাদার ইমামদের এ সম্মাননা দেওয়া হলে ইমামদের মধ্যে উৎসাহ বেড়ে যেত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো একটা প্রতিষ্ঠান যদি এমনটা করে তাহলে মানুষের ভরসার আর জায়গা কোথায়?

জসিম উদ্দিনের প্রতিবেশী জামান মিয়া বলেন, জসিম উদ্দিনকে আমরা কোনোদিন ইমামতি করতে দেখি নাই। তবে তিনি রাজনীতি করেন।

অপর প্রতিবেশী আছাব উদ্দিন বলেন, জসিম উদ্দিন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি করে। পাশাপাশি রাজনীতি করে। কিন্তু  ইমামতি করেন না। আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে এলাকার সবাইকে জিগান।

বারহাট্টা হাফিজিায়া দারুল উলুল মহিউসুন্নাহ মাদরাসার মোহতামিম ও বারহাট্টা বড় মসজিদের সাবেক ইমাম মাওলানা আনেয়ার হোসেন বলেন, জসিম উদ্দিন যাকে শ্রেষ্ঠ ইমামের পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তিনি গত ১৫ বছরেও কোনো মসজিদে ইমামতি করেননি। ইমামতি করতে আমরা তো অন্তত জানব। এমন নির্বাচনে ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। আমি ইমাম প্রশিক্ষণ নিয়েছি, বারহাট্টা বড় মসজিদে দীর্ঘ বছর ইমামতি করেছি। এখন মাদরাসায় ইমামতি করছি। অথচ এই তালিকায় যুগ যুগ ধরে ইমামতি করেন এমন কাউকে রাখা হয়নি। এটি বড় ধরনের একটি কারচুপি। সত্যিকার ইমামরা এ পুরস্কার পেলে অন্যরা এতে অনুপ্রেরণা পাবে। এতে ভালোর প্রতিযোগিতা হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে এমনটা আশা করা যায় না।

আরও পড়ুন

সিলেটে জনতার হাতে আটক আ.লীগ নেতা

এ বিষয়ে উপজেলা ওলামা দলের সভাপতি মাহবুব আলম বলেন, জসিম উদ্দিন উপজেলা ওলামা দলের সভাপতি থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়েছেন। এখন আবার হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলনসহ অনেক দলের নেতা তিনি। জসিম উদ্দিন কোনদিনও ইমামতি করেননি। তবুও ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাকে কীভাবে শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচন করল বুঝে আসছে না। জসিম উদ্দিনের পদের শেষ নেই।

এ বিষয়ে হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে কমপক্ষে ১৫টা প্রশিক্ষণ করেছি। ইমামতি করিনি এটা সঠিক নয়। অনেক আগে ইমামতি করেছি জেলা সদর ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ভেতরের মসজিদে। জেলা ওলামা দলের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। এক সময় জেলা ছাত্রদলের পদে ছিলাম। গত আওয়ামী আমলে ১৭টি মামলার আসামি হয়েছি। গ্রেফতার হয়েছি, জেল খেটেছি। একাধিক মানবাধিকার সংগঠনে আছি। পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠনের পদে আছি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোনা জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি এখানে যোগদান করেছি ফেব্রুয়ারিতে। ইমাম নির্বাচনের কাজটি করেছেন আগের উপ-পরিচালক শফিকুর রহমান সরকার। দুর্নীতির দায়ে তিনি বরখাস্ত হওয়ার পর আমি এখানে যোগদান করেছি। প্রতিটি উপজেলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাছাই কমিটি রয়েছে তারা প্রথমে বাছাই করে ২০ তালিকা জেলায় পাঠায়। পরে জেলায় চূড়ান্ত করা হয়।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর