জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবার চিত্র দিনদিন নাজুক অবস্থার রূপ নিচ্ছে। প্রায় দুই লাখ মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকট, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মে বিপর্যস্ত। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে প্রতিদিন রোগীরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি ক্লিনিকের দ্বারস্থ হচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন
কাগজে-কলমে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৪ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও আছে মাত্র ৬ জন চিকিৎসক। প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন। এত সংখ্যক রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে চিকিৎসক ও কর্মরত স্টাফরা চরম হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে দরিদ্র ও নিম্ন- মধ্যবিত্ত রোগীরা বারবার ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে জেলা সদর হাসপাতাল বা নিকটবর্তী বেসরকারি হাসপাতালে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সার্জারি, শিশুস্বাস্থ্য, চক্ষু, নাক-কান-গলা, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিকস, গাইনি, ডেন্টালসহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদশূন্য রয়েছে। ফলে গর্ভবতী, শিশু, হৃদরোগসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত মানুষরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। বাধ্য হয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছেন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। যার খরচ জোগানো অনেকেরই সাধ্যের বাইরে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সন্ধ্যার পর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগ কার্যত চিকিৎসক শূন্য থাকে। ওই সময় উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো), কিছু চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেন। আইন অনুযায়ী, এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া কারও চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি নেই। ফলে প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসার ঝুঁকিতে পড়ছেন সাধারণ রোগীরা।
বিজ্ঞাপন
উপজেলার শান্তিনগর এলাকার আহসান হাবিব গত সপ্তাহে জরুরি অবস্থায় এসে এমবিবিএস চিকিৎসক না পেয়ে বাধ্য হয়ে স্যাকমোর শরণাপন্ন হন। এমন ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে। ফলে অনেক রোগী গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। শুধু চিকিৎসক সংকটই নয়, অন্যান্য জনবলের ক্ষেত্রেও একই দৃশ্য বিরাজ করছে। ১৯৪ জন কর্মচারীর মধ্যে ৯৩টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ফলে পরিচ্ছন্নতা, রোগী পরিবহন, ওষুধ সরবরাহ ও নার্সিং সেবাসহ প্রতিটি বিভাগে চলছে তীব্র সংকট। নার্সের অভাবে ওয়ার্ডে রোগীদের সঠিকভাবে দেখভালও করা হয় না। ফলে অনেক রোগী কার্যত স্বনির্ভর হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরের স্যানিটেশন ব্যবস্থা এতটাই করুণ যে, দুর্গন্ধে রোগী ও স্বজনদের থাকা দায় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুরা বাথরুম ব্যবহারের সময় বারবার হোঁচট খাচ্ছেন।
![]()
অন্যদিকে আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রে, ইসিজি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অকেজো অবস্থায় রয়েছে। প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট না থাকায় এইসব যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা পুরোপুরি বন্ধ। জরুরি অপারেশনের প্রয়োজন হলেও সিজারিয়ানের মতো অস্ত্রোপচার প্রায় ছয় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। অনেকদিন ধরে তেলের বরাদ্দ না থাকায় জেনারেটরও বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলেই পুরো হাসপাতালে অন্ধকার নেমে আসে। আইপিএসও অকেজো হয়েছে। রোগীদের ভাষ্যমতে, বিদ্যুৎ না থাকলে শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ ও শিশু রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে। প্রচণ্ড গরম, মশার উপদ্রব ও আলোর অভাবে তারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বোড়াই গ্রামের আনজুমান গত মঙ্গলবার তার স্ত্রী রহিমাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। তিনি বলেন, ওই রাতে বিদ্যুতের চরম লোডশেডিং হয়েছিল। মোবাইলের আলোতে রোগীকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে হয়েছে। সারারাত খুব কষ্ট করতে হয়েছে। হাসপাতালও যেন রোগী হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি ওষুধ স্টোর থেকে উত্তোলন করা হলেও রোগীদের হাতে পৌঁছায় না। অনেক রোগী পকেটের টাকায় বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনেন। কিছু অসাধু কর্মচারীর সহযোগিতায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালচক্র। তারা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে কমিশনের আসায় নিয়ে যাচ্ছেন ওই বেসরকারি হাসপাতালে।
ধুনট গ্রামের আসমা বেগম বলেন, এই হাসপাতালে গাইনি চিকিৎসক না থাকায় তিনি প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন। তার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। বানদিঘী গ্রামের তাজরুল ইসলাম জানান, তার শিশুর চিকিৎসার জন্য সব পরীক্ষা বাইরে থেকে করাতে হয়েছে, যা তিনি সামলাতে পারেননি।
খায়রুল ইসলাম নামে আরেক রোগী বলেন, টাকা না দিলে ওয়ার্ড বয়রাও রোগীর গায়ে হাত দেয় না।
সামিউল নামে আরেক রোগী জানান, শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় তাকে জয়পুরহাট যেতে বলেছে। তাহলে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রেখে লাভ কী?
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহবুব উল আলম জানান, মাত্র কয়েকজন চিকিৎসক আর সীমিত সরঞ্জাম নিয়ে প্রতিদিন শতশত রোগীকে সেবা দেওয়া কার্যত অসম্ভব। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি কিন্তু জনবল ও প্রযুক্তির ঘাটতির কারণে মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও বাস্তব সমাধান আসছে না।
প্রতিনিধি/এসএস

