ভোর ছয়টা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিসর্গঘেরা মাঠে তখনো ঘুম ভাঙেনি প্রকৃতির। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সোনালু গাছে বসেছে কয়েকটি শ্যামা পাখি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজছে মাঠের বাঁশের বেঞ্চি। নিঃস্তব্ধতায় ডুবে থাকা এই সবুজ ক্যাম্পাসে তখনই দেখা মেলে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্যের—সারিবদ্ধভাবে হেঁটে আসছেন ১৯ জন নারী। পরনে কারও হিজাব, কারও মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস।
পেছনে পেছনে আসছেন এক মধ্যবয়সী পুরুষ—আব্দুল মান্নান। লুঙ্গি গুঁজে বসে পলিথিনের পুঁটলি থেকে বের করছেন সবার জন্য বড় বড় ময়লার ব্যাগ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা ছড়িয়ে পড়লেন চারপাশে—কে কুড়াচ্ছেন পলিথিন, কে বোতল, কে আবার জমে থাকা পচা পাতাগুলো সরাচ্ছেন। এই কাজ চলবে সকাল নয়টা পর্যন্ত।
বিজ্ঞাপন

তিন ঘণ্টার এই পরিশ্রমের বিনিময়ে তাদের আয় ২০০ টাকা। এই টাকা হয়ত কারও সন্তানের স্কুল ফি, কারো বৃদ্ধ বাবার ওষুধ, কিংবা একবেলা রান্নার চাল। কিন্তু তবুও, প্রতিদিন ঠিক ভোরেই তারা হাজির হন এই সবুজ ক্যাম্পাসে—কারণ, কাজটা শুধু জীবিকার নয়, এটা যেন এক ধরনের দায়বদ্ধতা। পরিচ্ছন্নতা, আত্মমর্যাদা আর নীরবে এগিয়ে চলা এক পরিবর্তনের ধারা।
এই কাজের নেপথ্যে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন, যার ভাবনা থেকেই এতো কিছু। যখন তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন ক্যাম্পাস ঘুরে দেখে তার হৃদয়ে জন্ম নেয় এক দ্বৈত অনুভূতি—একদিকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, অন্যদিকে যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে থাকা আবর্জনায় আচ্ছন্ন সেই সৌন্দর্যের গলায় বিষফোড়া।
‘এমন সুন্দর ক্যাম্পাস! অথচ ময়লার কারণে এর সৌন্দর্য যেন ব্যথিত হয়ে আছে,’ —আক্ষেপ করে বললেন এই উপ-উপাচার্য। আর এখান থেকেই শুরু হয় এক বাস্তব চিন্তার প্রতিফলন। গঠন করা হয় ‘সৌন্দর্যবর্ধন কমিটি’। পরে আরো একধাপ এগিয়ে গঠন করা হয় ‘ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি’।
বিজ্ঞাপন

এরপর পুরো ক্যাম্পাসের একটা মানচিত্র তৈরি করলেন— কোথায় কোথায় লাগানো হবে ডাস্টবিন, কীভাবে বর্জ্য বাছাই করে ফেলতে হবে, কোথায় হবে কেন্দ্রীয় ডাম্পিং স্টেশন। স্থাপন করা হলো পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যের জন্য পৃথক ডাস্টবিন। কিন্তু সমস্যা থেকে গেল—মানুষ নিয়ম মানছে না, আর পরিষ্কারের জন্য নেই পর্যাপ্ত জনবলও।
ঠিক তখনই মাথায় আসে এক নতুন ভাবনা। রাজশাহী সফরে গিয়ে এক ভোরে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া কয়েকজন নারীর দৃশ্য তাকে ভাবায়— ‘ওরা পারলে আমরা কেন পারবো না?’ ফিরে এসে তিনি পুরো ক্যাম্পাসকে ভাগ করলেন ১৯টি জোনে। প্রতিটি জোনের জন্য নিযুক্ত করলেন একজন করে নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব—নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার রাখা এবং ময়লা নির্ধারিত ডাস্টবিনে ফেলা।
‘নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের এই সময়সীমা নির্ধারণের পেছনে একটি চিন্তা কাজ করেছে’- বললেন অধ্যাপক কামাল। তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তরগুলো খুলে যায়, তাই তার আগেই ক্যাম্পাস পরিষ্কার থাকলে একদিকে পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকবে, অন্যদিকে নারী কর্মীরা দিনের বাকিটা সময় অন্য কাজে ব্যয় করতে পারবেন। কারণ, আমাদের পক্ষে ফুলটাইম নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়।’

এই কর্মসূচিতে যুক্ত আছেন আরও চারজন পুরুষ কর্মী, যারা সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসের প্রতিটি ডাস্টবিন থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যান। সেখানে অপচনশীল বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হয়, আর পচনশীল বর্জ্য প্রাকৃতিকভাবে সারে রূপান্তরিত হয়।
পুরো ব্যবস্থাটি চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাজেট থেকে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নারী কর্মীদের দেওয়া হচ্ছে মাসে ৬ হাজার টাকা, আর পুরুষ কর্মীদের ১৫ হাজার টাকা। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দেওয়া হচ্ছে গ্লাভস, মাস্ক ও প্রয়োজনীয় উপকরণ। উপ-উপাচার্য ড. কামাল বলেন, ‘আমরা তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব সচেতন। পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি, তাদের মর্যাদাটাও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপাচার্য ও হিসাব নিয়ামকের পরামর্শে আমরা কাজটি হাতে নেই। এই পুরো কার্যক্রমটি প্রকৌশল দপ্তরের রাশেদ ভাই এবং জামাল নজরুল ইসলাম গবেষণাগারের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মুসা ভাই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন। এছাড়াও আমার অফিসের সদস্যরাও আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেন।’
এই পুরো উদ্যোগের নেপথ্য সংগঠক আব্দুল মান্নান নিজেও এক সময় ক্যাম্পাসে মাটি কেটেছেন, চা বিক্রি করেছেন। পরে এক দুর্ঘটনায় থমকে দাঁড়ায় তার জীবনের চাকা। এরপর আবার শুরু হয় নতুন পথচলা, উপ-উপাচার্যের ডাকে। আজ তিনি ২৩ জন কর্মীর অভিভাবক সদৃশ ‘তত্ত্বাবধায়ক’।
![]()
এই নীরবে ঘাম ঝরানো যোদ্ধাদের কেউ চিনে না, তারা নেই কোনো ক্যাম্পেইনে, তাদের ছবি নেই কোনো দেয়ালে। অথচ তাদের হাত ধরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ধীরে ধীরে হাঁটছে পরিচ্ছন্নতার দিকে।
উপ-উপাচার্য বলেন, “এখন ছাত্ররাও সচেতন হচ্ছে। কেউ কোথাও ময়লা দেখলে আমাকে ফোন দেয়। আমি লোক পাঠিয়ে তা পরিষ্কার করানোর চেষ্টা করি। আগের তুলনায় ক্যাম্পাস এখন অনেক পরিষ্কার।” এই উদ্যোগে যুক্ত হচ্ছে ক্যাম্পাসের পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনও। তিনি মনে করেন, “এটা একটা সামাজিক আন্দোলন—সবাইকে নিয়েই আমাদের ক্যাম্পাসটাকে পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব।”
এই পুরো কার্যক্রম যেন এক সামাজিক পরিবর্তনের দৃশ্যপট। প্রতিদিন সকালে যখন শহরের অন্য প্রান্তে ঘুম ভাঙে কেবল ঘড়ির শব্দে, তখন চবির এই সবুজ ক্যাম্পাসে সূচনা হয় এক নীরব বিপ্লবের, যেখানে প্রতিটি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর হাতে ধরা থাকে স্বপ্ন, আত্মমর্যাদা আর বদলে দেওয়ার গল্প।
প্রতিনিধি/ এজে

