শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ধর্ম আর বর্ণমালা আবিষ্কার করে ৩৬ বছর ধ‌রে নিখোঁজ মেনলে ম্রো

সুফল চাকমা
প্রকাশিত: ১৯ জুন ২০২২, ০৮:০৩ পিএম

শেয়ার করুন:

ধর্ম আর বর্ণমালা আবিষ্কার করে ৩৬ বছর ধ‌রে নিখোঁজ মেনলে ম্রো
এই ঘরে মেনলে ম্রো পাথরের ওপর বসে ধ্যান করতেন | ছবি: ঢাকা মেইল

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম ম্রো সম্প্রদায়। জেলার ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ম্রো একটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী। তারা ম্রুং, ম্রো নামেও পরিচিত। প্রকৃত পরিচয় ম্রো হলেও বাংলাদেশে তারা ম্রুং/ মুরং নামে পরিচিত। বান্দরবানের নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে এরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ।

চিম্বুক পাহাড়ে ঘেঁষা এই জেলার পাদদেশের একটি গ্রাম পোড়া ম্রো পাড়া। জেলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের সুয়ালক ইউনিয়নের এই গ্রামেই ১৯৬৫ সালের কোনো এক রোববার জন্মগ্রহণ করেন মেনলে ম্রো। নির্দিষ্ট তারিখ কেউ জানেন না। এখা‌নেই ম্রো জনগোষ্ঠীর ছেলে মেনলের বসবাস।


বিজ্ঞাপন


দিনভর মেনলে ম্রো ঘুরে বেড়াতেন পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রামে। বিভিন্ন ঝর্ণায় ঘুরে ছোটো ছোটো মাছ শিকার করতেন। নয়তো কয়েক কিলোমিটার হেঁটে এ পাড়া- সে পাড়ায় ঘুরে একটু শান্তি খুঁজতেন। সে সময়ে কোনো রাস্তাঘাট না থাকায় যাতায়াত করতে হতো পায়ে হেঁটেই। এভাবে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে বেড়ানোর পরও যেন মেনলে ম্রো’র মনে এতটুকুও প্রশান্তি হচ্ছিল না।

মেনলে ম্রো’র দুঃখ তাদের ধর্মের কোনো নাম নেই। মেনলে জানেন- তিনজন দেবতা আছেন। বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ‘থুরাই’ পাহাড়ের দেবতা ‘সাংতুং’ আর নদীর দেবতা ‘ওরেং’। এমনকি মেনলে ম্রো পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে ঘুরে এ-ও শুনেছে- বাইরের পৃথিবীর মানুষ কতরকম ধর্ম মানে।

Bandorbon Story
এই পাথরে বসে মেনলে ধ্যান করতেন, তার অনুসারীরা এখনো পাথরে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থণা করেন | ছবি: ঢাকা মেইল

মেনলে ম্রোর আরও একটা দুঃখ আছে। সেটা হলো তার গ্রামে কোনো স্কুল নেই। তাই প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা করতে পারেন না তিনি। মনের কথাও লিখতে পারেন না। কারণ, ম্রো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই।


বিজ্ঞাপন


তবে মেনলে ম্রো’র জীবনে আশার আলো এলো ১৯৮১ সালে। তখন তার বয়স ১৫ বছর। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়নে তৈরি হলো ‘ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়’। ওই সময় মেনলে ম্রো স্কুলে পড়ার জন্য ছুটে গেলেও তাকে নিতে অসম্মতি জানানো হলো। কারণ, প্রাথমিক স্তরে পড়ার বয়স শেষ। এতে স্কুলের সামনেই অনশন শুরু করলেন নাছোড়বান্দা মেনলে। পরে প্রধান শিক্ষক টিএনমং, মেনলের জেদের কাছে হার মানলেন। স্কুলে ভর্তি হওয়া মেনলে ম্রো’র আনন্দ তখন আর দেখে কে!

পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী মেনলে ম্রো, ভর্তির কয়েক মাসের মধ্যে ডবল প্রমোশন পেয়ে ক্লাস টু এবং পরের বছরই চতুর্থ শ্রেণিতে উঠে পড়ল। তবে স্কুলে পড়তে হয় বাংলা বর্ণমালা। কিন্তু মেনলের মনে দুঃখ- তারা আদিম এক জনজাতি, এই জনজাতিতে আছেন লাখো মানুষ। তা সত্ত্বেও তাদের পড়তে হচ্ছে অন্য ভাষার বর্ণমালা। যে ভাষা তার মাতৃভাষা নয়।

ফলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় ম্রো ভাষার প্রথম লিপি তৈরিতে হাত দিলেন। তবে ১৮ বছরের ভাবুক যুবক মেনলে ম্রো পঞ্চম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করেই বাড়ি ফিরলেন। পড়ার অত্যন্ত ইচ্ছে থাকলেও হলো না। কারণ, মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল অনেক দূরে। তাছাড়া ১৮ বছরের ছেলেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি নেওয়া হবে না, এটা মেনলেও বুঝে গিয়েছিল।

Bandorban Story
দুই নাতনির সহযোগীতায় ধর্মীয় সভায় যাচ্ছেন বর্তমান সময়ে ক্রামা ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু মেনচিং ম্রো (৯০) | ছবি: ঢাকা মেইল

এদিকে, গ্রামে ফিরেই ক্রমশই পাল্টে যেতে শুরু করেছিল মেনলে। তার মনে হচ্ছিল- এ পৃথিবী তার নিজের পৃথিবী। ম্রো জনগোষ্ঠী তার নিজের জাতি। কিন্তু তারা কত পিছিয়ে আছে। এ নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। না আছে শিক্ষা, না আছে ধর্ম, না আছে ধর্মগ্রন্থ, না আছে উপাসনা গৃহ। পরবর্তীকালে ১৯৮৪ সালে একক প্রচেষ্টায় মেনলে ম্রো আবিষ্কার করে ফেললেন ম্রো বর্ণমালা। তার বর্ণমালায় ছিল ৩১টি বর্ণ।

যুবক মেনলে সারাদিন গুহায়, বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। নিজের মনেই বিড়বিড় করতেন। পাহাড়ি গুল্মের রস দিয়ে রং তৈরি করে ছবি আঁকতেন যেখানে-সেখানে। সবশেষে ১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক গ্রামবাসীর সামনে মেনলে প্রকাশ করলেন তার আবিষ্কৃত ‘ক্রামা’ বা ‘ম্রো’ বর্ণমালা।

মেনলে শুধু ধর্ম আর বর্ণমালা আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি ম্রো জাতির সমাজে বেঁচে থাকার সুশৃঙ্খল সামাজিক জীবনযাপনের পদ্ধতিও জানিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন: ম্রো ভাষায় চাউপ (শিক্ষা বিভাগ), রিউপ (ধর্মীয় বিভাগ), রিপউপ (বিচার বিভাগ), ক্রাউপ (আইন বিভাগ), চখাংউপ (চিকিৎসা বিভাগ) ইত্যাদি। এতে একেক বিভাগে একেকজনের দায়িত্ব দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় মেনলে ‘ম্রো’ জনগোষ্ঠীকে উপহার দিলেন এক নতুন ধর্ম, নাম ‘ক্রামা’।

Bandorban Story
বাঁশি বাজিয়ে বর্তমান ক্রামা ধর্মের প্রধান মেনচিং ম্রো’কে স্বাগত জানাচ্ছে ম্রো সম্প্রদায় | ছবি: ঢাকা মেইল

মেনলে ম্রো’র প্রধান শিষ্য লেং য়াং ম্রো ঢাকা মেইলকে বলেন, সেদিন হাজার হাজার গ্রামবাসী মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলেন মেনলে ম্রো’র ‘ক্রামা’ ধর্মের নীতিকথা। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। ম্রো জাতির হাজার হাজার নরনারী, সেই বৃষ্টিভেজা দিনে চিৎকার করে কেঁদেছিল আর বলেছিল, ‘মেনলে তুমি মানুষ নও। তুমি হলে আমাদের ঈশ্বর (ক্রামাদি)। তুমি স্বর্গের দেবদূত। তুমি সৃষ্টি করে দিয়েছো বর্ণমালা। তাই তুমি ঈশ্বর-পুত্র।’

এরই ধারাবাহিকতায় ৫ এপ্রিল থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ‘ক্রামা’ ধর্মের প্রবর্তক মেনলে ম্রো ধর্মীয় অনুশাসন, নীতিবাক্য প্রচার করেছিলেন বান্দরবানের পাড়ায় পাড়ায়। ওই সময় ম্রো জনগোষ্ঠীর বহু মানুষ তাঁর ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু ওই বছরই (১৯৮৬) ১৫ আগস্ট হঠাৎই হারিয়ে যান মেনলে ম্রো। এরপর থেকে তিনি এখনও নিখোঁজ।

সেই ১৯৮৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি ক্রামাদি মেনলে ম্রো’কে। কেউ বলেন- দেবতারা তাকে নিয়ে গেছেন সোনার রথে করে। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, মেনলে ম্রো আরকান ও ভারত হয়ে হিমালয়ে গেছেন ধ্যান করতে। এমনকি মেনলে যাবার সময় না কি এ-ও বলে গেছেন, ‘আমি তপস্যা করতে গেলাম। আবার ফিরে আসব।’

Bandorban Story
১৫ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণিতে এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে অনশন করেছিলেন মেনলে ম্রো | ছবি: ঢাকা মেইল

মেনলে ম্রো’র হারিয়ে যাওয়ার পর কেটে গেছে ৩৬ বছর। ক্রামাদি মেনলে ম্রো প্রবর্তিত ধর্মমত আর আবিষ্কৃত বর্ণমালা আজ স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁর বাণী রিইয়ুং-খ্তি (নীতিকথা) নামে একটি বইয়ে সংকলিত করা হয়েছে। প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার ওই বইটি বাংলা ও ইংরেজিতেও অনুবাদ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মেনলে ম্রো প্রবর্তিত ‘ক্রামা বা ম্রো বর্ণমালার কম্পিউটার ফন্টও তৈরি হয়েছে। এমনকি তাঁর আবিষ্কার করা বর্ণমালায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বইও ছাপা হচ্ছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে ম্রো বর্ণমালায় সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ।

এতসব হলেও নেই মেনলে ম্রো। কেউ জানে না তিনি কোথায়। আদৌ জীবিত আছেন কি না। কিন্তু তাঁর তো পৃথিবী ছাড়ার বয়স হয়নি, হিসেব মতে তাঁর বয়স এখন মাত্র ৫২ বছর। তাই ম্রো জাতি এখনও তাঁর পথ চেয়ে আছে। তাঁরা মনে করেন- একদিন সাদা ঘোড়ায় চেপে পূর্ব দিক থেকে ফিরে আসবেন তাঁদের ঈশ্বর ‘ক্রামাদি’। তাই রোজ সকালে পূর্বদিকে তাকিয়ে ‘ক্রামা’ ধর্মের উপাসকরা বলেন- ‘আমাদের জন্য সুসংবাদ নিয়ে ওই যে তিনি আসছেন।’

Bandorban Story
ধর্মীয় সভায় বর্তমান ক্রামাধর্মের প্রধান মেনচিং ম্রো (মাথায় সাদা কাপড়) মধ্যমনি হয়ে বসে রয়েছেন | ছবি: ঢাকা মেইল

বর্তমান বিশ্বের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ মানুষই হয়তো ক্রামাদি মেনলে ম্রো’র নাম-ই শোনেননি। কিন্তু সারা বিশ্বে তিনি ছাড়া আর একটি মানুষও নেই, যিনি একটি জাতিকে একই সঙ্গে ধর্ম এবং বর্ণমালা উপহার দিয়েছেন। তাই তো ম্রো জাতি তাঁকে আরও ভুলে যায়নি, ভুলে যায়নি ‘ক্রামা’ ধর্মের অনুগামীরাও। সেই সঙ্গে ভুলেনি হাজার হাজার স্কুলপড়ুয়া ম্রো শিশুও। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস- মেনলে কোনো একসময় ফিরে আসবেন। সেদিনের প্রত্যাশায় চিম্বুক পাহাড়ের পথপানে আজও চেয়ে আছে হাজারো ম্রো জনগোষ্ঠীর মানুষ।

এ বিষয়ে ম্রো সমাজের লেখক, গবেষক ইয়াং ঙান ম্রো ঢাকা মেইলকে বলেন, ম্রো জাতির পথ প্রদর্শক মেনলে’র দেখানো পথ অনুসরণ করেই ২৮টি বই লিখতে সক্ষম হয়েছি। ক্রামাদি মেনলের বর্ণমালা দিয়েই ১৮টি বই ম্রো ভাষায় ও ১০টি বাংলায় বই লিখতে পেরেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি- মেনলে’র দেখানো পথ যদি অনুসরণ করতে পারি, তবেই ম্রো জাতি মুক্তির পথ মিলবে, নয়তো নয়। এ সময় ক্রামাদি মেনলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, মেনলে ম্রোর কারণে ম্রো জনগোষ্ঠী বর্ণমালা ও ধর্ম পেয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে।

উল্লেখ্য, বর্তমান ক্রামা ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরুর নাম ক্রামাদি মেনসিং ম্রো। বয়স ৯০ বছর। প্রতিবছর পৌষ পূর্ণিমায় হাজারো ক্রামা ধর্মের অনুসারীরা একত্রিত হন তার কাছে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা বিচার-বিশ্লেষণ করেন।

/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর