- কাঙ্ক্ষিত মাছ নিয়ে উপকূলে ফিরতে শুরু করেছেন জেলেরা
- নীরবতা ভেঙেছে ফিশারি ঘাট ও জেলেপল্লিগুলো
সাগরে মাছ ধরায় ছিল নিষেধাজ্ঞা। তাতে উপকূলজুড়ে নেমে আসে নীরবতা। স্থবির হয়ে পড়ে সবকটি ফিশারি ঘাট ও জেলেপল্লি। দীর্ঘ ৫৮ দিন স্থায়ী হয় এই বিরতি। অবশেষে ১১ জুন মধ্যরাতে শেষ হয় সেই নিষেধাজ্ঞা। এরপরই উপকূলীয় এলাকার শত শত জেলে ট্রলার ও নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন সাগরে।
বিজ্ঞাপন
ইতোমধ্যে অনেকে ইলিশসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ নিয়ে উপকূলে ফিরতে শুরু করেছেন। তাতে পুরনো কর্মচাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে ফিশারি ঘাট ও জেলেপল্লিগুলোতে। জেলেসহ সংশ্লিষ্টদের মুখে ফিরেছে হাসির ফোয়ারা।
শনিবার (১৪ জুন) সকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর ফিশারি ঘাটে মাছভর্তি ট্রলার ও নৌকা নিয়ে সাগর থেকে ফিরেছেন অনেক জেলে। তাঁদের একজন আনোয়ারা উপজেলার পারকি এলাকার আবদুল কাদের। ট্রলার থেকে নেমেই মুখভরা হাসিতে তিনি জানান, সাগরে আশানুরূপ মাছ ধরা পড়ছে। ইলিশও আছে। বাজারে সরবরাহের লক্ষ্যে মাছ নিয়ে এসেছি, যেন দ্রুত ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারি।
তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর ১১ জুন মধ্যরাতেই আমরা কয়েকজন জেলে ট্রলার নিয়ে সাগরে যাই। যদিও গভীর সাগরে যাইনি, তবে সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও ফেনী উপকূলের অনেক জেলেকে মাছ ধরতে দেখা গেছে। আমরাও তাঁদের সঙ্গে মাছ ধরা শুরু করি এবং আশানুরূপ মাছ পেয়েছি। আমার সঙ্গে ৩০-৩২টি ট্রলার ও নৌকাও মাছ নিয়ে ফিরে এসেছে।
আবদুল কাদের আরও জানান, অধিকাংশ গভীর সমুদ্রগামী ট্রলার এখনো সাগরে রয়েছে। তারাও প্রচুর মাছ ধরার খবর দিয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী ৩-৪ দিনের মধ্যে তারা মাছ নিয়ে ফিরবে। তখন বাজারে প্রচুর সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একই কথা বলেন আনোয়ারা উপজেলার সর্ববৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র 'উঠান মাঝির ঘাটে' ফেরা জেলে নিরুপম দাস। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষে মন উতলা হয়ে উঠেছিল। তাই নৌকা, জাল, নোঙর, তেল, বরফ, জ্বালানি ও খাবার নিয়ে সাগরে যাই। উপকূলের কাছাকাছি থেকেই মাছ ধরেছি। দুই দিনেই যা মাছ পেয়েছি, তা আশাব্যঞ্জক। ইলিশও ধরেছি। সেগুলো বাজারে দিয়ে আবার মাছ ধরতে যাব। এবার গভীর সাগরে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।
এদিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া জেলেপল্লিতেও মাছ নিয়ে ফেরার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন জেলে। তাঁদের একজন নিরঞ্জন জলদাস বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষের রাতেই আমাদের জেলেপল্লির ৩০-৩২ জন ১০-১২টি নৌকা নিয়ে সাগরে গিয়েছিলাম। উপকূলের কাছেই মাছ ধরেছি। কিছু মাছ পেয়েছি, ইলিশও ধরেছি। তবে সেগুলো তেমন বড় নয়, মাঝারি আকারের। নৌকায় পর্যাপ্ত রসদ ছিল না বলে গভীর সাগরে যাইনি। তাই যা পেয়েছি, তা নিয়েই ফিরে এসেছি।
জেলেরা জানান, সাগরে মাছ ধরতে ফেনী, নোয়াখালী, বরগুনা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলের অসংখ্য জেলে ট্রলার ও নৌকা নিয়ে গেছে। কেউ কেউ উপকূলের কাছ থেকে মাছ ধরলেও অধিকাংশই গেছে গভীর সাগরে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে জেলেরা মাছ নিয়ে উপকূলে ফিরে আসবেন।
স্থানীয়ভাবে বহদ্দার হিসেবে পরিচিত নুরুল ইসলাম নামের এক ট্রলার মালিক বলেন, প্রতিটি বোটে এক জোতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ পড়ে। এই খরচ পুষিয়ে লাভ করতে হলে প্রতিটি বোটে অন্তত ৫০ মণ মাছ ধরতে হয়। আমরা আশাবাদী, এবার সাগরে প্রচুর মাছ পাওয়া যাবে এবং জেলেরা ভালো ফল পাবেন।
তিনি আরও জানান, সাগর থেকে ফেরা নৌকা ও ট্রলারের মাছ সংরক্ষণ ও বাজারজাত করার প্রস্তুতিও চলছে। জেলে পরিবারগুলোও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগরীর চাক্তাই ফিশারি ঘাটেও কর্মব্যস্ততা বেড়েছে। সেখানে মাছের আড়তগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে ও প্রয়োজনীয় সংস্কার চলছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ফিশারি ঘাটের মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল ইশতেশাম জানান, শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৩২-৩৩টি ট্রলার ও নৌকা সাগর থেকে মাছ নিয়ে ফিরেছে। আনোয়ারা, বাঁশখালী ও সীতাকুণ্ড থেকে আসা ট্রলার ও নৌকাগুলোর প্রতিটিতে প্রায় অর্ধেক পরিমাণ মাছ ছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ১১০০ মণ মাছ জেলেরা ধরেছেন, যা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে সরবরাহ করা হয়েছে।
ফিশারি ঘাটের 'সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতি'র সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকার বলেন, সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৬৭ হাজার মাছ ধরার যান সাগরে নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে ফিশারি ঘাটসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ১০ হাজার ট্রলার মাছ শিকার করে। এতে প্রায় ২ লাখ জেলে নিয়োজিত আছেন।
তিনি জানান, ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ১১ জুন মধ্যরাতে প্রায় ১ হাজার ট্রলার সাগরে যায়। এর মধ্যে উপকূলের কাছে থাকা ট্রলার ও নৌকার জেলেরা মাছ ধরে ফিরতে শুরু করেছেন। বিগত কয়েক বছর মৌসুমের শুরুতে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণে মাছ কম পাওয়া গিয়েছিল। তবে এবার এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রতিকূলতা দেখা যায়নি। আমরা আশাবাদী, জেলেরা এবার হাসিমুখে ফিরবেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমিতির আনোয়ারা শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রীকৃষ্ণ দাস বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমাদের জেলেরা মানবেতর জীবন যাপন করে। তারা ধৈর্যের পরীক্ষা দেয় এই সময়ে। এবার সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। আমরা আশা করি, তারা এবার আশানুরূপ মাছ নিয়ে নিরাপদে উপকূলে ফিরতে পারবে।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর প্রথমবারের মতো প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের জন্য সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাংলাদেশ সরকার। এই সময়টিকে ইলিশসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের প্রজননের জন্য উপযোগী ধরা হয়। নিষেধাজ্ঞার সময় সফলভাবে কার্যকর হওয়ায় মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে, অন্তত ৪৭৫টি সামুদ্রিক মাছের প্রজাতির প্রজনন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
প্রতিনিধি/একেবি

