ঈদুল আজহার টানা ছুটিতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে অন্তত কয়েক লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। গত রোববার সকাল থেকে আসতে শুরু করেন পর্যটকরা। হোটেল কক্ষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই তারা নেমে পড়েন সমুদ্রসৈকতে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈকতজুড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেলের কোথাও কোনও খালি কক্ষ নেই। সবগুলো আগাম বুকিং হয়ে গেছে।
বিজ্ঞাপন
কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটছেন এদিক-সেদিক, কেউ মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত। কেউ আবার দ্রুতগতির নৌযান ‘জেডস্কি’ নিয়ে ঘুরে আসছেন সমুদ্রের বিশাল জলরাশি থেকে। অনেকে আবার বালুচরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো কিটকিটে (ছাতাযুক্ত চেয়ার) বসে সমুদ্রের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছেন।
কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে মানুষের মেলা। বুধবার (১১ জুন) দুপুর ১২টা পর্যন্ত সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে জড়ো হয়েছেন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ। প্রচণ্ড গরমের এই দুপুরে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ সমুদ্রে নেমে গোসলে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সৈকত ভ্রমণে আসা বেশিরভাগ মানুষের প্রধান আকর্ষণ হলো সমুদ্রের নোনা জলে নেমে শরীর ভেজানো। ঠান্ডা হাওয়া উপেক্ষা করে সকাল থেকেই লাখো পর্যটক পানিতে নেমেছেন। সমুদ্রের নীল জলরাশি উপভোগ করে তারা ছুটছেন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের দিকে। অনেকে আশপাশের বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে ঘুরছেন।
সমুদ্রসৈকত ছাড়াও কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্র , হিমছড়ি ঝরনা, পাথুরে সৈকত ইনানী-পাটুয়ারটেক, টেকনাফ সমুদ্রসৈকত, ঐতিহাসিক প্রেমের নিদর্শন মাথিন কূপ, নেচার পার্ক, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, রামুর বৌদ্ধ পল্লিসহ বিনোদনকেন্দ্রগুলো এখন জমজমাট।
বিজ্ঞাপন
সি সেফ লাইফ গার্ডের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমদ জানান, পর্যটকরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সমুদ্রে নেমে গোসল করেছেন। তাদের সামাল দিতে লাইফগার্ড কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়।
হোটেল মালিকরা বলছেন, বেশকিছু দিন ধরে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ছিল নিস্তব্ধ। পর্যটকশূন্যতার কারণে হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও রিসোর্টগুলোর কক্ষ ভাড়া ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হলেও তেমন সাড়া মেলেনি। বন্ধ ছিল পর্যটননির্ভর রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য ব্যবসা। তবে সেই নীরবতা ভেঙে গেছে ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিনে। ঈদের প্রথমদিন ৭ জুন দুপুর থেকেই স্থানীয় পর্যটকরা আসতে শুরু করে সৈকতে । রোববার থেকে অন্যান্য জেলা থেকেও পর্যটকদের আগমন বেড়ে যায়। এরপর থেকে সৈকতে লাখো পর্যটকের সমাগম হয়। এর আগে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। আগামী ১৫ জুন পর্যন্ত কক্সবাজারে প্রায় ৬-৭ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা । ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক হোটেল রিসোর্ট, গেস্ট হাউসের ৯০ শতাংশ কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে গেছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ ও লাইফগার্ড কর্মীরা জানান, ঈদের প্রথম দিন শনিবার সৈকতে নেমেছিলেন মাত্র তিন হাজার পর্যটক। ঈদের দ্বিতীয় দিন রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত লাখো পর্যটক সৈকতে নেমেছেন। এরপর ক্রমান্বয়ে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
কক্সবাজার কলাতলী- মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, ‘আজ দুপুর ১২টা থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে ৭০ হাজারের বেশি পর্যটক উঠেছেন। সন্ধ্যা নাগাদ আরও কয়েক হাজার আসবেন। বুধবার থেকে শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-রিসোর্টে থাকার জায়গা হবে না। আজ মাঝারি আকারের কিছু হোটেলে ১০ থেকে ১২ শতাংশ কক্ষ খালি থাকলেও তারকা মানের হোটেল-রিসোর্টের কোনও কক্ষ খালি নেই। আগে কক্ষ বুকিং না দিলে পর্যটকের চাপের কারণে বিপাকে পড়তে হয়।’
শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-গেস্ট হাউস-রিসোর্টের দৈনিক ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৮৭ হাজার উল্লেখ করে মুকিম খান বলেন, বর্ষাকালে এমনিতেই হোটেল মালিকদের ব্যবসা খারাপ যায়। এ কারণে ঈদ পরবর্তী হোটেলে ছাড়ের সুযোগ নেই। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে পর্যটকদের জন্য সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ কক্ষ ভাড়া ছাড়ের ব্যবস্থা রেখেছেন কিছু হোটেল মালিক। পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়ের কারণে কোনও হোটেল মালিক যেন নির্ধারিত মূল্যের বেশি কক্ষ ভাড়া আদায় করতে না পারেন সে বিষয়ে নজরদারি রাখা হচ্ছে।
পর্যটন উদ্যোক্তা রেজাউল করিম রেজা বলেন, আমরা আশা করছি এবারের ছুটিতে কয়েক লাখ পর্যটক আসবেন। সেজন্য পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত আছে। পাশাপাশি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সেবার বিষয়েও আমরা সতর্ক আছি।
রেস্তোরাঁ মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, এবার পর্যটকদের ভাল ছাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি ভালো বাণিজ্য হবে।
লাবণী পয়েন্টের জেলা পরিষদ মার্কেট ও আশপাশের বালিয়াড়িতে শামুক-ঝিনুক, শুঁটকিসহ অন্যান্য পণ্যের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও বেচাকেনা শুরু করেছেন। শামুক-ঝিনুক ব্যবসায়ী গফুর উদ্দিন জানান, বর্ষাকালে বৃষ্টি ও নানা ঝামেলায় ব্যবসা ভালো চলেনা। তবে এবার ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের ঢল নামবে বলে আশা করছেন তিনি।
সৈকতে চেয়ার-ছাতা ব্যবসায়ী, ওয়াটার বাইক ও বিচ বাইকের পরিচালকদের পাশাপাশি ঘোড়ার মালিকরাও মঙ্গলবার ব্যস্ত সময় পার করেছেন। ঘোড়া মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদা আক্তার বলেন, ঈদের ছুটিতে পর্যটকের ঢল নেমেছে। ব্যবসা বাণিজ্য বেশ জমে উঠেছে।
পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনটি জানিয়েছেন, ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের সহকারী পুলিশ সুপার নিত্যানন্দ দাস বলেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক টহল ব্যবস্থা আছে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সক্রিয় রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ঈদের ছুটিতে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত হোটেল ভাড়া এবং রেস্তোরাঁগুলোয় খাবারের দাম যেন বেশি আদায় করা না হয়, সেসব তদারকির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামানো হয়েছে। পর্যটকদের নির্বিঘ্ন সেবা দিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় সভা করা হয়েছে। অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিনিধি/ এজে