বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫, ঢাকা

ঈদের ছুটিতে মহাস্থানগড়ে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা

জেলা প্রতিনিধি, বগুড়া
প্রকাশিত: ০৮ জুন ২০২৫, ১২:০২ পিএম

শেয়ার করুন:

ঈদের ছুটিতে মহাস্থানগড়ে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা

আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে উঠা সমৃদ্ধ এক জনপদরে নাম পুণ্ড্রর্বধন। খ্রীষ্টর্পূব তৃতীয় শতকে যার রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর। কালের পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে যা মহাস্থানগড় হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে। ১৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত  পুণ্ড্রনগরীতে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৩২টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে৷ বাংলার সর্বপ্রাচীন এই জনপদ সার্ক কালচারাল ক্যাপিটাল বা সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী। বছর জুড়েই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে এই প্রত্নস্থান। 

bogura_2


বিজ্ঞাপন


মহাস্থানগড়ের অবস্থান বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা। বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গেলে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়৷ প্রাচীর বেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান মৌর্য, গুপ্ত, গৌড়, পাল, বৌদ্ধ রাজারা ও সেন শাসকদের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্য বৌদ্ধ রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজারা রাজত্ব করেন। এখানে মুসলিম শাসনামলেরও বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। নানা সময়ে খননকালে আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরে। ফুলের বাগানে ঘেরা যাদুঘরে ঢুকতেই এর চারপাশে দেখা যাবে প্রাচীন কালের  অলংকৃত পাথর, স্তম্ভের পাদবেদী, কালো পাথরের স্তম্ভ সহ অসংখ্য নিদর্শন। এছাড়াও নানান সময়ের মুদ্রা, গহনা,   দেব-দেবী মূর্তি, আসবাবপত্র সহ অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক সংরক্ষিত রয়েছে এই যাদুঘরে। 

bogura_3

যাদুঘরের পাশেই রয়েছে গোবিন্দ ভিটা। গোবিন্দ ভিটা শব্দের অর্থ হিন্দু দেবতা গোবিন্দ তথা বিষ্ণুর আবাস। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের কোনো নিদর্শন এ স্থানে পাওয়া যায়নি। তবুও প্রত্নস্থলটি স্থানীয়ভাবে গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত। গোবিন্দ ভিটায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। মন্দিরটি খ্রীষ্ঠীয় আনুমানিক সাত শতকে নির্মিত হয়েছিল। যেখানে একাধিকবার পুনঃনির্মাণের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। এ প্রত্নস্থলে আবিষ্কৃত অন্যান্য প্রত্নবস্তুর মধ্যে ছাঁচে ঢালা তাম্র মুদ্রা, রৌপ্য মুদ্রা, উত্তর ভারতীয় কালো চকচকে মৃৎপাত্রের টুকরা, শুঙ্গযুগীয় শিল্প বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পোড়ামাটির ফলক, ব্রাক্ষী হরফ সংবলিত পোড়ামাটির সীল, স্বল্প মূল্যবান পাথর গুটিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

bogura_4


বিজ্ঞাপন


মৃত মানুষ জীবিত হওয়ার লোকগাথা রয়েছে যে কূপকে ঘিরে সেই জিয়ৎ কুন্ডের অবস্থান মহাস্থান গড়ের ভেতরেই। রাজা পরশুরামের শাসনামলে তার প্রাসাদ নির্মাণের সময় এই কূপটি খনন করা হয়েছিল। শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার তার শিষ্যদের নিয়ে ফকিরবেশে একটি মাছের পিঠে মহাস্থানগড় এসেছিলেন। সেখান থেকে তার নাম এসেছে মাহিসা ওয়ারর। মহাস্থানগড় পৌঁছে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। প্রথমে রাজা পরশুরামের সেনাপ্রধান, মন্ত্রী এবং কিছু সাধারণ মানুষ ইসলামের বার্তা গ্রহণ করে মুসলিম হয়, এভাবে পুন্ড্রবর্ধনের মানুষ হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকলে রাজা পরশুরামের সাথে শাহ সুলতানের বিরোধ বাধে এবং এক সময় যুদ্ধ শুরু হয়। রাজা পরশুরাম যখন শাহ সুলতান বলখী মহীসওয়ারের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন তখন তিনি এই কূপের পানির সাহায্যে মৃত সৈনিকদের জীবিত করতেন। এটি শাহ সুলতান শোনার পর তিনি একটি চিলের সাহায্যে একটুকরু গরুর মাংস এই কূপে ফেলে দেন। এরপর থেকে এ কূপের পানির অলৌকিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধে রাজা পরশুরাম পরাজিত হন এবং মৃত্যুবরণ  করেন। বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে রাজার মেয়ে রাজকন্যা শিলাদেবী করতোয়া নদীতে ডুবে মরেন। তার ডুবে যাওয়ার আশেপাশের অঞ্চলটি শিলা দেবীর ঘাট হিসাবে পরিচিত।

bogura_5

গোকুল মেধ গোকুল গ্রামে খননকৃত একটি প্রত্নস্থল। স্থানীয়ভাবে এটি বেহুলার বাসর ঘর নামেই অধিক পরিচিত। তবে প্রকৃতপক্ষে  এটি বেহুলার বাসর ঘর নয়। এটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে ১৭২ টি বন্ধ প্রকোষ্ঠের সমন্বয়ে গঠিত ১৩ মিটার উঁচু একটি মঞ্চের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এ মঞ্চের সমতল শিরোদেশ প্রথম নির্মাণ যুগে একটি বৌদ্ধ উপাসনালয় নির্মিত হয়েছিল। এরপর সেন আমলে এ ধ্বংসাবশেষে একটি বর্গাকৃতির শিব মন্দির নির্মিত হয়েছিল। এখানে বহু গর্তযুক্ত একটি ছোট প্রস্তর খণ্ডের সঙ্গে ষাঁড়ের প্রতিকৃতির একটি স্বর্ণ পত্র পাওয়া গিয়েছিল। এ থেকে ধারণা করা হয়, এটি বর্গাকৃতির শিবমন্দির ছিল। এ মন্দিরের কক্ষ থেকে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে একটি নর কঙ্কাল, একটি ইটের নির্মিত গোলাকার গর্ত, একটি শিলাখণ্ড ও ষাঁড়ের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ একটি স্বর্ণ পত্র।  প্রত্নতাত্ত্বিক এসব নিদর্শন কাছ থেকে দেখার জন্য প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে এখানে।

bogura

ঈদ এলেই মহাস্থানগড় দর্শনার্থীদের ভিড়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে যায়। চলতি ঈদেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ঈদের প্রথম দিন থেকেই পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বগুড়াসহ আশপাশের জেলা থেকে দর্শনার্থীরা মহাস্থানে ভিড় করছেন। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জোরদার ব্যবস্থা নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

যেভাবে যাওয়া যাবে মহাস্থানগড়ে: মহাস্থানগড় বগুড়া শহর থেকে ১২  কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। মহাস্থানগড়ে যেতে হলে শহরের সাতমাথা থেকে পায়ে চালিত রিকশা অথবা অটোরিকশায় যেতে হবে দত্তবাড়ীতে। সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগবে ৪ থেকে ৭ মিনিট।  এরপর দত্তবাড়ী থেকে থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে ২০ টাকা ভাড়ায় সরাসরি পৌঁছে যেতে পারবেন মহাস্থান শাহ সুলতান বলখীর মাজারের দরজা পর্যন্ত। কেউ যদি সিএনজি অটোরিকশাতে না যেতে চাইলে বাসে যেতে পারবেন। বাসে মহাস্থানগড়ে যেতে হলে তাকে দত্তবাড়ী থেকে মাটিডালি যেতে হবে। মাটিডালি থেকে পর্যাপ্ত বাস পাওয়া যাবে মহাস্থানগড়ে যাওয়ার জন্য।

bogura_6

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী মহাস্থানগড়সহ সংলগ্ন এলাকায় প্রতি বছর দেশি-বিদেশি প্রায় ৫ লাখ দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করছে  প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর (মহাস্থানগড়) বগুড়ার কাস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতানা।

প্রতিনিধি/এজে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর