ঈদের দিন সকাল। চারদিকে খুশির আমেজ। কিশোরগঞ্জ শহরে তখন গন্তব্য শুধু একদিকে মোড় নেয়— ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। উপমহাদেশের অন্যতম এবং দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ঈদগাহ হিসেবে পরিচিত এই মাঠে শনিবার (৭ জুন) সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আজহার ১৯৮তম জামাত। ঢল নামে লাখো মুসল্লির। অতীত ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আবেগে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
ঈদের জামাতে ইমামতি করেন মুফতি আবুল খায়ের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। উল্লেখ্য, দীর্ঘ একযুগ পর তিনি আবার এই ঈদগাহে ইমামতি করলেন। তার কণ্ঠে তাকবির ধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় নামাজ। নামাজ শেষে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি কামনায় মোনাজাত করা হয়।
বিজ্ঞাপন
জামাতে অংশ নেন কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমান। মাঠজুড়ে প্রার্থনার দৃশ্য ছিল একটি ছবির মতো; যেখানে সব বয়সী মানুষ আল্লাহর দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়েছে একসঙ্গে।
জনশ্রুতি আছে, এই মাঠের নাম ‘শোলাকিয়া’ এসেছে প্রথম জামাতে ‘সোয়া লাখ’ মুসল্লি অংশ নিয়েছিলেন বলেই। কেউ বলেন, তৎকালীন পীর শাহ সুফি সৈয়দ আহমদের মোনাজাতে উচ্চারিত ‘সোয়া লাখ’ কথাটিই কালের পরিক্রমায় হয়ে গেছে ‘শোলাকিয়া’।
এই মাঠে নামাজ আদায়ের আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে মুসলমানদের কাছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, শোলাকিয়ায় নামাজ পড়লে সওয়াব বেশি মেলে। তাই দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চল থেকে মানুষ ছুটে আসেন এই মাঠে।
এই ঈদগাহ ময়দানে রয়েছে ২৬৫টি কাতার। প্রতিটি কাতারে নামাজ পড়তে পারেন প্রায় ৫০০ জন মুসল্লি। ফলে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে এ জামাত পরিণত হয় ঈদের সবচেয়ে বড় মিলনমেলায়।
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালের ৭ জুলাই ভয়াবহ জঙ্গি হামলার দুঃসহ স্মৃতি শোলাকিয়া ঈদগাহ এখনও বহন করে। ওইদিন ঈদের আয়োজনে হামলায় শহীদ হন দুই পুলিশ সদস্য, এক নারী ও এক হামলাকারী। আহত হন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১৬ মুসল্লি।
এই ঘটনার পর থেকে প্রতি বছর এখানে নেওয়া হয় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এবারের জামাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকা রেঞ্জের পুলিশ সুপার (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ফিন্যান্স) মো. কাজেম উদ্দীন জানান, শোলাকিয়া ঈদগাহকে ঘিরে চার স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন সাদা পোশাকে। বসানো হয়েছিল আর্চওয়ে গেট, ওয়াচ টাওয়ার, ড্রোন ক্যামেরা, বাইনোকুলার, ভিডিও ক্যামেরা এবং ২৪ ঘণ্টা কার্যকর সিসি ক্যামেরা।
নিরাপত্তার পাশাপাশি মুসল্লিদের যাতায়াত সহজ করতে চালু রাখা হয় ‘শোলাকিয়া ঈদ স্পেশাল’ নামের দুটি বিশেষ ট্রেন— একটি ভৈরবগামী এবং অপরটি ময়মনসিংহগামী। এই ট্রেন দুইটি ঈদের দিনে কয়েক দফায় মানুষ বহন করে শোলাকিয়ায়।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মিজাবে রহমত জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা এবং ব্যবস্থাপনায় ছিল কঠোর মনিটরিং। লাখো মুসল্লির উপস্থিতি সত্ত্বেও জামাত শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। বিশেষ ট্রেনসহ সবধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠটি ১৯৫০ সালে স্থানীয় দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ, যিনি মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর, ৪.৩৫ একর জমি ওয়াকফ করে প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ঈদগাহ কেবল নামাজের স্থান নয়, এটি হয়ে উঠেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার এক সেতুবন্ধন।
২০২০ ও ২০২১ সালে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে দুই বছর বিরতির পর আবারও গত বছর থেকে লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণে ফিরে এসেছে পুরনো চিত্র।
মুসল্লিরা জানান, যত বাধাই আসুক, শোলাকিয়ার মাটিতে নামাজ আদায় না করলে ঈদের আনন্দ পূর্ণ হয় না। তবে মুসল্লিদের দাবি, আরো উন্নযনের ছোয়া লাগুক ঐতিহাসিক এই মাঠে।
ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই মিলন। আর শোলাকিয়া মানেই ঈদের সেই আনন্দের বিস্তার— যেখানে একসাথে দাঁড়িয়ে যায় ধর্মপ্রাণ লাখো মানুষ। ইতিহাস, আবেগ আর নিরাপত্তার এক অপূর্ব সমন্বয়ে আবারও গর্বিত হল শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান।
প্রতিনিধি/এফএ