সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

হালদায় এবার ‘মা’ মাছ দিল ১৪ হাজার কেজি ডিম, চলছে রেণু ফোটানোর মহাযজ্ঞ

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ৩১ মে ২০২৫, ০৭:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

হালদায় এবার ‘মা’ মাছ দিল ১৪ হাজার কেজি ডিম, চলছে রেণু ফোটানোর মহাযজ্ঞ

দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে এবার মা মাছ ছেড়েছে বিপুল পরিমাণ ডিম। সেখান থেকে জেলেরা সংগ্রহ করেছেন ১৪ হাজার ১৬৫ কেজি ডিম, যা গত বছরের তুলনায় সাড়ে ৩ হাজার কেজি বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, সাগরে লঘুচাপের প্রভাবে মৌসুমের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারের সময় বজ্রসহ বৃষ্টির পর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে হালদা নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। ফলে নদীর বিভিন্ন অংশে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ প্রজাতির মা মাছ ডিম ছাড়ে।


বিজ্ঞাপন


এরপর ৩৫০টি নৌকা ও ৪০০টি জাল নিয়ে ৬৫০ জন জেলে হালদা নদীর মদুনাঘাট, ছায়ার চর, রামদাস মুন্সিরহাট, আমতুয়া, নাপিতার গোনা, আজিমের ঘাট, মাছুয়া গোনা, কাগতিয়া, আইডিএফ হ্যাচারি, সিপাহী ঘাট, নোয়াহাট, কেরামতালির বাক এবং অঙ্কুরিগোনা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ডিম সংগ্রহে নামেন।

প্রথম দিকে খুবই সামান্য পরিমাণে নমুনা ডিম পাওয়া যায়। পরে শুক্রবার দুপুরের দিকে জোয়ার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমের পরিমাণ বাড়তে থাকে। শুক্রবার (৩০ মে) সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ডিম সংগ্রহের কার্যক্রম। এ সময়ে মোট ১৪ হাজার ১৬৫ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।

এই ডিম ফুটানোর কাজে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলেরা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে ডিম সংগ্রহ ও পরিবেশ মনিটরিংয়ের কাজ করছে। ডিম সংগ্রহকে কেন্দ্র করে নদীর তীরজুড়ে বইছে উৎসবের আমেজ।

ড. মনজুরুল কিবরিয়া আরও জানান, ২০২৪ সালে হালদা নদীতে মাত্র ১ হাজার ৬৬০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর আগে ২০২৩ সালে ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি, ২০২২ ও ২০২১ সালে এর চেয়েও কম ডিম পাওয়া যায়। তবে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।


বিজ্ঞাপন


চট্টগ্রাম জেলার সিনিয়র সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে পেরে জেলেরা খুবই আনন্দিত। বর্তমানে সরকারি ৬টি হ্যাচারি এবং মৎস্যজীবীদের উদ্যোগে ৬৮টি মাটির কুয়ায় ডিম ফুটানোর কাজ চলছে।

শনিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, হালদা নদীর হাটহাজারী অংশে অবস্থিত মদুনাঘাট হ্যাচারি, শাহ মাদারী হ্যাচারি ও মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে জেলেরা রেণু ফোটানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রশিক্ষিত ডিম সংগ্রাহকদের মধ্যে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)-এর উদ্যোগে আধুনিকায়নকৃত মাটির কুয়ায় রেণু ফোটানোর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি নদীর দুই তীরে স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির মাটির কুয়াতেও রেণু ফোটানোর কাজ চলছে।

আইডিএফ কর্মকর্তারা জানান, এবার পরিবেশ মোটামুটি শীতল থাকায় রেণু উৎপাদনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। হালদার পোনা সাধারণ হ্যাচারির পোনার তুলনায় দ্রুত বর্ধনশীল। ডিম সংগ্রাহকেরা হ্যাচারির কুয়া ও স্থানীয় কুয়ায় রেণু ফোটিয়ে তা বাজারজাত করে আয় করেন। নিষিক্ত এসব ডিম থেকে উৎপন্ন রেণুর প্রতিকেজির মূল্য দেড় লাখ টাকারও বেশি। রেণু বিক্রি ও মাছ চাষের মাধ্যমে ডিম সংগ্রাহকেরা সারা বছর জীবিকা নির্বাহ করেন।

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ে। তবে এর কিছু প্রাকৃতিক শর্ত থাকে—পূর্ণিমা বা অমাবস্যা, বজ্রসহ বৃষ্টিপাত, নদীতে ফেনাসহ পাহাড়ি ঢল এবং পূর্ণ জোয়ার বা ভাটার পর পানি যখন স্থির হয়, তখনই মা মাছ ডিম ছাড়ে।

এই হিসেব অনুযায়ী এপ্রিল থেকেই হালদা পাড়ের জেলেরা ডিম সংগ্রহের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। এর মধ্যে গত ২৭ মে ভোর রাতে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের ফলে নদীতে প্রথম দফায় নমুনা ডিম ছেড়ে মা মাছ। তখন স্বল্প পরিমাণে নিষিক্ত ডিম পাওয়া যায়।

কিন্তু নদীতে পাহাড়ি ঢল না থাকায় মা মাছ ডিম ছাড়েনি পুরোদমে। এরপর থেকে জেলেরা জাল ও নৌকা নিয়ে নদীর তীরে অপেক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মা মাছ ব্যাপকভাবে ডিম ছাড়ে।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, খাগড়াছড়ির বাটনাতলী পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ১০৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হালদা নদী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে মিলেছে। দেশের একমাত্র জোয়ার-ভাটার রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এই নদীর সুরক্ষায় সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তার ফলস্বরূপ এই বিপুল পরিমাণ মাছের ডিম আহরণ সম্ভব হয়েছে, যা মাছের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর