সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘আমিতো কাউকে মারিনি, তাইলে আমার সঙ্গে এমন ক্যান হইল’

মো. আল-আমিন, শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ২৭ মে ২০২৫, ০১:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

Attack

পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে আছেন রমিজ উদ্দিন হাওলাদার ও তার স্ত্রী বকুল বেগম—নিস্তব্ধ, নিঃশেষ, নীরব। পাঁচ দিন পর ফিরেছেন তারা নিজের ভিটেমাটিতে, কিন্তু যা দেখলেন, তা কেবল ছাই আর কান্নার গল্প। জীবনের সব সঞ্চয়, ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের ফল, ভালোবাসার সংসার—সব হারিয়ে আজ তারা নিঃস্ব। গায়ে শুধু একটি জামা, আর চোখে এক বুক হাহাকার।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কুচাইপট্টি ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মোতাইতের পরিবারের সঙ্গে একই এলাকার কাশেম আলী খাঁয়ের পরিবারের জমি সংক্রান্ত ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। বুধবার দুপুরে সেই বিরোধকে কেন্দ্র করে শেরু মার্কেট এলাকায় কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আবুল কাশেমের ওপর হামলা চালায় কাশেম আলী খাঁয়ের লোকজন। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে দ্রুত উদ্ধার করে গোসারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নিয়ে আসলে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। এদিকে আবুল কাশেমের মৃত্যুর খবর চরমাইঝারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে প্রতিপক্ষের লোকজনের অন্তত ৭টি বসতঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ছয়টি বসতঘর ভাঙচুর করার পাশাপাশি লুটপাটের অভিযোগ উঠে। পরে খবর পেয়ে গোসাইরহাট থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এই ঘটনায় পরদিন ৫২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের বড় ভাই জসিম মোতাইত। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।


বিজ্ঞাপন


1000188195

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আলাদা আলাদা তিনটি স্থানে দেওয়া আগুনে পুড়ে গিয়েছে অন্তত ৭টি বসতঘর। ঘরে থাকা শস্যদানাসহ সব আসবাবপত্র পুড়ে গিয়েছে। আগুনে নারিকেল গাছ, কাঁঠালগাছগুলো ও তার ফলগুলো পুড়ে গেছে। বুধবার দেওয়া আগুনে গতকাল বিকেলে পর্যন্ত দু’টি ঘরের মধ্যে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। এছাড়াও পুরো এলাকা থমথমে বিরাজ করছে।

1000188196

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী বকুল বেগম জানান, বুধবার দুপুরে শেরু মার্কেট এলাকায় পূর্ব শত্রুতার জেরে খুন হয় স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মোতাইত। যা চর মাইঝারা এলাকা থেকে অন্তত ৪ কিলোমিটার দূরে। যা পরবর্তীতে তারা জানতে পারেন। এদিকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে অন্তত শতাধিক দুর্বৃত্ত দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় রমিজ উদ্দিন হাওলাদারসহ অন্তত ১৫টি বসতবাড়িতে। এ সময় তাদের বাড়িঘরগুলো থেকে টাকাপয়সা, মূল্যবান সামগ্রী এবং গরু ছাগল লুট শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। যা থেকে অবশিষ্ট কোনো কিছুই বাঁচাতে পারেনি তারা। লুট হয়েছে আটটি গরু ও তিনটি ছাগল। বকুল বেগমের দাবি, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় তারা। শুধুমাত্র দল করার কারণে প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়তে হয়েছে তাদের। একইসাথে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবুল কাশেম মোতাইতের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারাই জড়িত  বিচারের দাবি জানান ও নিরপরাধ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার কথা জানান।


বিজ্ঞাপন


1000188197

তার স্বামী রমিজ উদ্দিন হাওলাদার ঘরের সামনে বসে অনবরত কেঁদেই চলেছিল। প্রশ্ন করা হলে, একটু থেমে বলেন, ‘কি বলব বাজান, দুঃখে দুঃখে আমার জনমডা গেল। ছোডবেলা থেকে কৃষি কাম করে কষ্টে বড় হইছি। আইজ আমার সব শ্যাষ। আল্লাহ এইডা কি করল। আমার দুইডা ঘর পুইড়া শ্যাষ। আমিতো কাউকে মারিনি। তাইলে আমার সাথে এমন ক্যান হইল’।

1000188198

এদিকে লুটপাট থেকে রেহাই পায়নি দল না করা ব্যক্তিরাও, দাবি ভুক্তভোগীদের। এমনি একজন নারী আয়েশা বেগম। চলার পথে হঠাৎ সাংবাদিক দেখে এগিয়ে আসেন তিনি। জানতে চান আমরা সরকারি লোক কি-না। আর আমরা তার লুট হওয়া গরু উদ্ধারে সহযোগিতা করতে পারব কি-না।  কথা বলার একপর্যায়ে তিনি জানান, চার বছর আগে স্বামী আনোয়ার হোসেন শিকদার মারা যায়। এরপর থেকে ১১ বছরের মেয়ে সান্ত্বনা ও ৯ বছরের ছেলে ইব্রাহিম খলিলুল্লাহকে নিয়ে বসবাস করে আসছেন। পরিবারের অভাব অনটন ঘোচাতে লালনপালন করতেন দু’টি গরু ও একটি ছাগল। গত বুধবার লুটপাটের সময়ে তার গরুটি মাঠেই বাঁধা ছিল। খবর পেয়ে তিনি তার গরুটি আনতে গেলে রোষানলে পড়েন লুটপাটকারীদের। একপর্যায়ে তাকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখালে বাধ্যহয়ে কিছুই করতে পারেননি তিনি। চোখের সামনে থেকে লুট হয়ে যায় তার গরুটি।

1000188199

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমরা স্বামী মারা যাওয়ার পর খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার একটা গরু আছিল। সেদিন লুটের সময় সেটাও নিয়া গেছে। আমরা তো কারও দলবল করি নাই। ছোট দুইডা বাচ্চা লইয়া কোনোমতে বাইচ্চা আছি। আমি আমার মাল ফেরত চাই। আপনারা একটু ব্যবস্থা করে দেন। আমার তো কেউ নাই, চলার মতো পথও নাই।

1000188193

এদিকে ঘটনার পর পুরো এলাকা হয়ে পড়েছে পুরুষ শূন্য। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করায় জনমনেও রয়েছে আতঙ্ক। শুধুমাত্র ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে পোড়া ঘরবাড়ি আর গাছগাছালি। পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারির পাশাপাশি ঘটনাস্থলে রয়েছে গ্রাম পুলিশও। তাছাড়া যারা মামলার আসামি নয় তাদের আর আশ্বস্ত করা হয়েছে বাড়িতে ফেরার জন্য।

আরও পড়ুন

নদীর চর থেকে শিকলে বাঁধা মরদেহ উদ্ধার

এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদী জসিম মোতাইতের মুঠোফোন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাই তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোসাইরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাকসুদ আলম বলেন, হত্যার ঘটনায় এজাহার পাওয়ার পর মামলা দায়ের হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের বিষয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি। আসলে আমরা আইনগতভাবে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেব। ভবিষ্যতে যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেজন্য আমাদের প্রশাসন তৎপর রয়েছে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর