চা শিল্পের শিল্পী চা-শ্রমিকের জীবনটা বাগানের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সংসারের স্বচ্ছলতা থাকলে মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। কিন্তু সবুজ কুঁড়ি বেষ্টিত চা বাগানের সীমানাতেই আটকে আছে তাদের জীবনযাত্রা।
চা-বাগানের নারী চা-শ্রমিকের অপুষ্ট শরীর, মলিন পরিধান আর ক্লান্তির ছাপ উধাও হয়ে যায় সপ্তাহের একটি দিন, একটি মুহূর্তের জন্য। এটি ঘটে তলববারে তলব বাজারে।
বিজ্ঞাপন
সপ্তাহের যে দিনটিতে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয়, সেদিনকে বলে তলববার। এর সঙ্গে মিল রেখে একই দিনে বাগানে বসা অস্থায়ী বাজারের নাম তলব বাজার।
![]()
বৃহস্পতিবার (১ মে) এমনই এক তলববারে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের মিরতিংগা চা বাগানে গিয়ে দেখা যায়, এখানে এক অস্থায়ী বাজার ঘিরে চা-শ্রমিকদের মিলনমেলা বসেছে।
তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পান-সুপারি থেকে শুরু করে শাকসবজি, মাছ, খই-মুড়কি মিষ্টান্ন, চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে গৃহস্থালির বিচিত্রসব জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। এছাড়াও অল্প দামে সুন্দর সুন্দর পোশাক নিয়ে আসেন তারা। আয় যত কমই হোক, শ্রমিকেরা সপ্তাহের এই একটি দিন মজুরির টাকা পেয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য সবটুকু স্নেহ উজাড় করে দিতে চান এটা-সেটা কিনে।
বিজ্ঞাপন
![]()
স্থানীয়রা জানান, তলববারে বাগান থেকে পাতা তোলা শেষ করে, ওজন দিয়ে সাধারণত বাড়ি চলে যান চা-শ্রমিকেরা। পরিচ্ছন্ন হয়ে পোশাক বদলে আসেন মজুরি নিতে। সপ্তাহান্তে প্রায় বারো শ থেকে দেড় হাজার টাকা হাতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান তারা।
তলব বাজারের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। এই দিনে তলব বাজারে বেচাকেনা ভালো হয়। তবে তারা সোমবারেও পসরা নিয়ে আসেন। এই অস্থায়ী বাজার বিকেল ৪টায় বসে। চলে রাত ৮টা পর্যন্ত।
৪২ বছর ধরে এই বাজারে ব্যবসা করছেন সামাদ মিয়া। তিনি বলেন, আমরা সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবারে এখানে আসি। সোমবারে সাধারণত বেশিরভাগ পণ্য বাকিতেই বিক্রি করি। তবে তলববারে আমাদের কেনাবেচা ভালো হয়। সেদিন বাকি পরিশোধ করে নগদ টাকায় কেনাকাটা করেন চা-শ্রমিকেরা।
![]()
বাগানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহের একটি দিন শ্রমিকদের নাম ধরে ডেকে ডেকে মজুরি দেওয়া হয় বলেই ‘তলব’ শব্দটি ব্যবহার হয়। সব বাগানেই বসে অস্থায়ী এই তলব বাজার। প্রচলনটি ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম চা-বাগান তৈরির সময় থেকেই এই প্রথা চলে আসছে। অধিকাংশ বাগানের তলববার বুধবার। তবে রোববার চা-শ্রমিকদের ছুটির দিন বাদে অন্যদিন হতে পারে দিনটি।
ষাটোর্ধ্ব চা-শ্রমিক রমেশ রাজভর বলেন, বহু প্রজন্ম ধরে জেনে এসেছি চা বাগানে সপ্তাহের একটি দিনে তলব বাজার বসে। এটা ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু হচ্ছে। চা-বাগান ঘিরে শ্রমিকদের জন্য এই বাজার বসার প্রচলনের বয়স শত বছরের।
২০ টাকার এক জোড়া কানের দুল ও ৫০ টাকায় একপিস নাকফুল নিজের কন্যা সন্তানের জন্য কিনে নেন নারী চা-শ্রমিক সুফলা রানী। তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের মেয়ের কানের দুল ও নাকফুল আছে, তা দেখে আমার মেয়েও বায়না ধরেছে। আজ মজুরি পেয়ে প্রথমেই তার জিনিস কিনলাম।
![]()
আমরা অনেক কষ্টে সংসার চালাই। যা টাকা পাই সেটা দিয়ে কোনোমতে দিন পার করি। সেটাও যখন পাই না, তখন চলবে কীভাবে? তখনই বাকিতে শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনি। তলববারে যখন টাকা পাই তখন সংসারের অন্যান্য খরচপাতি করি। কথাগুলো বলছিলেন চা-শ্রমিক গায়েত্রী বুনার্জি।
যত পশ্চিমে হেলে সূর্য, ততই বাড়তে থাকে ভিড়। বাজারের কাছে বড় বটগাছের পাশে এক জটলা দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, পোশাকের একটি দোকান ঘিরে এমন জটলা। পুঁতি বসানো, জরির কাজ করা একটু লাল রঙের জামার গায়ে দামি ব্র্যান্ডের ট্যাগ লাগানো ছিল। ওটাই বারবার নেড়েচেড়ে শেষে ১২০ টাকায় নিয়ে নিলেন চা-শ্রমিক কঙ্কনা পার্শি। তিনি বলেন, কদিন পর কাকার ছেলের বিয়ে, তাই জামাটা নিলাম নিজের ১২ বছর বয়সী মেয়ের জন্য।
![]()
তলব বাজার থেকে ফেরার পথে চা বাগানের মধ্যে সন্ধ্যা নামল। ছোট মেয়েকে নিয়ে সুষমা রানী তখন বাড়ির পথে ফিরছেন। হাতের প্যাকেটের বস্তুটি কী, জানতে চাইলে একটু লজ্জা পেয়ে নিজেই বললেন, মেয়ের জন্য কপালের টিপ, হাতের চুড়ি ও আলতা কিনলাম। মেয়ে খুবই শখ।
চা-শিল্পের শিল্পীরা সারাদিন বাগানে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে রোদে পুড়ে মলিন হয়ে যায় মুখ। কিন্তু, তলববারে সেই মুখেও তখন দেখা মিলল একটু আনন্দের রঙিন ঝিলিক। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ আর আলতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় সেই রঙিন মুহূর্তের সময়টুকু।
প্রতিনিধি/এসএস

