রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মেঘনায় বিলীন হওয়া হাতিয়ার আন্ধারমানিক-সাগরদীই হলো ভাসানচর

ছায়েদ আহামেদ, হাতিয়া (নোয়াখালী)
প্রকাশিত: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০০ পিএম

শেয়ার করুন:

মেঘনায় বিলীন হওয়া হাতিয়ার আন্ধারমানিক-সাগরদীই হলো ভাসানচর

১৯১৩-১৬ সালে নোয়াখালীর সীমানা নির্ধারণী ম্যাপে হাতিয়ার উত্তর-পূর্বে এ দ্বীপের হরনী ও চানন্দী ইউনিয়নের আন্ধারমানিক-সাগরদী নামীয় জায়গাটুকু অবস্থিত। যা ১৯২০ সালের নদী ভাঙনের শুরুতে বিলীন হয়ে যায়। গেল শতকের ৯৪-৯৫ সালের দিকে সে জায়গাটুকু নতুন করে জেগে উঠলে হাতিয়ার আওতায় রেখে ভাসানচর নাম দিয়ে বন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেটভুক্ত করে শরণার্থী সেন্টার স্টেশন করা হয়। নতুন করে চরটি পার্শ্ববর্তী সন্দ্বীপ উপজেলা তাদের দাবি করায় হাতিয়াবাসী এর প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ, সংশ্লিষ্ট দফতরে স্মারকলিপি, আইনি নোটিশ প্রদানসহ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।

thumbnail_IMG-20250419-WA0008


বিজ্ঞাপন


নোয়াখালী গেজেট, নোয়াখালী ও সন্দ্বীপের ইতিহাস

কৈলাস সিংয়ের রাজমালা, কাজী মোজাম্মেল হকের তিন হাজার বছরের নোয়াখালী সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯২০ সাল থেকে হাতিয়ায় নদীভাঙন শুরু হলেও ১৯৫০ সালের দিকে রামগতি ও লক্ষ্মীপুর সদরের সঙ্গে তোয়াহ্ বাঁধ এবং ১৯৬২ সালে রামগতি ও মান্নান নগরের বাঁধের ফলে এ ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এসময় দ্বীপের নীলক্ষী-চরবাটা, হরনী ও চানন্দী ইউনিয়নের সাগরদী, আন্ধারমানিক, হজিমিজি ও তদসংলগ্ন অনেকগুলো আবাদি চর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে হাতিয়ার মানচিত্রকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। ষাটের দশক থেকে অব্যাহত ভাঙনে দ্বীপের সমৃদ্ধ জনপদ রাধাখালি, চিত্রাখালি, বাথানখালি, মাইজচরা, চরভারতসেন, সাহেবানী, চৌরঙ্গী, মফিজিয়া, সুখচর, নলচিরা, গোডাউন বাজার অন্যতম। এখন নদী ভাঙন হাতিয়ার নিত্যসঙ্গী। প্রায় ৭০ বছর ভাঙনে হাতিয়ার প্রায় ৮৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

thumbnail_FB_IMG_1745019069936

গত শতকের ৯৪-৯৫ সালের দিকে হাতিয়ার সীমানায় বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার মোহনায় জালিয়ার চর, ঠেঙ্গার চরসহ কয়েকটি চর জেগে উঠে। যেখানে ২০০২-২০০৩ সালে হাতিয়া বনবিভাগ বনায়ন সৃজন করে বলে জানান নলচিরা রেঞ্জ। যা বনদস্যু-জলদস্যুদের দখলে চলে যায়। চর সমূহের পাশ দিয়ে তখন বিভিন্ন মালবাহী বোট-কার্গো জাহাজ চলাচলের সময় প্রায়ই দস্যুর কবলে পড়ত বলে জানান হাতিয়ার সিনিয়র সাংবাদিক ইফতেখার হোসেন তুহিন।


বিজ্ঞাপন


thumbnail_IMG20250419173640

২০২১ সালের ১৬ জুলাই নোয়াখালী উপকূলীয় বনবিভাগের গেজেটভুক্ত বনভূমির বিবরণীতে দেখা যায়, ফরেস্ট সেটেলমেন্ট কার্যালয় ২০১১ সালের ২৫ আগস্ট জালিয়ার চরের ১০ হাজার একর বনভূমির ৫ হাজার একর সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে । অবশিষ্ট ৫ হাজার একর ভূমি হাতিয়া উপজেলাস্থ জালিয়ার চরকে ‘ভাসানচর’ নাম দিয়ে সেখানে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের সেন্টার স্টেশন স্থাপনে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভাসানচর তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।

thumbnail_Screenshot_2025-04-19-11-41-36-58_a27b88515698e5a58d06d430da63049d

এর আগে ২০১২ সালের ১৯ নভেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিশাখা-১ এর প্রজ্ঞাপনে ১৮ ডিসেম্বর সরকারি প্রকাশিত গেজেটে উল্লেখ করা হয়- নোয়াখালী জেলার অধীন ‘২২°৫৫'' উত্তর অক্ষাংশ হতে ৯০°৫০'' ‘পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ও ২১°৩০''’ উত্তর অক্ষাংশ হতে ৯১°৩০''’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যবর্তী স্থানে নতুন জেগে ওঠা চর ভূমি বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশ করতে এর অবস্থান ও সীমানা নির্দিষ্ট করে বনটি সংরক্ষিত হলে উক্ত ভূমিতে কারও কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে উহা নোটিশ জারির তারিখ হতে ৪ মাসের মধ্যে প্রামানিক দলিলপত্রসহ নিয়োগকৃত ফরেস্ট সেটেলমেন্ট অফিসারের কাছে জানানোর জন্য আহ্বান করা হয়।

thumbnail_Screenshot_2025-04-19-11-40-38-03_a27b88515698e5a58d06d430da63049d

যেহেতু বর্ণিত ঘোষণার প্রেক্ষিতে এর বিপরীতে কোনো দাবি-দাওয়া উপস্থাপিত হয় নাই বা উপস্থাপিত হওয়ার পর আইনসঙ্গতভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে, সেহেতু বন আইন ১৯২৭ এর ২০ ধারার ক্ষমতা বলে বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে হাতিয়ার সংরক্ষিত বনভূমি বলে গণ্য হয় মর্মে ঘোষিত হয় ।

IMG-20250416-WA0018

একই সঙ্গে, ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ভাসানচরকে হাতিয়ার ০৫ নম্বর চরঈশ্বর ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা- ভাসানচর, শালিক চর, চর বাতায়ন,  চর মোহনা, চর কাজলা, কেওড়ার চরের জে এল নং- ৮৫, ৮৬, ৮৭, ৮৭, ৮৯, ৯০ নিয়ে ‘ভাসান চর’ থানা গঠন করা হয়। যা একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। এর পূর্বে ২০১৬-১৭ জরিপ মৌসুমে চরটিতে দিয়ারা জরিপ পরিচালনা করা হয়। পরে হাতিয়ার ভূমিহীনদের মাঝে জেগে ওঠা এ ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের জন্য বাসযোগ্য করা হয়। চরটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়। এসময় নোয়াখালী ও হাতিয়া উপজেলা এবং পুলিশ প্রশাসনকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে।

thumbnail_Screenshot_2025-04-17-11-24-50-84_a27b88515698e5a58d06d430da63049d

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সন্দ্বীপ নোয়াখালীর আওতায় ছিল, যা হাতিয়া কোর্টেরও এখতিয়ারভুক্ত ছিল। হাতিয়ার এমএনএ মাওলানা আব্দুল হাইয়ের প্রশাসনিক এলাকাও ছিল এ সন্দ্বীপ ও রামগতি এলাকা। ১৯৫৫ সালে সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।

IMG-20250415-WA0001

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের অনেক জায়গায় দেখা যায়, বিচ্ছিন্ন অনেক উপজেলা বা এলাকা রয়েছে নিকটবর্তী জেলার সীমানায় না পড়ে ঐতিহাসিক কারণে দূরবর্তী জেলার সীমানায় পড়েছে। বড় উদাহরণ কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা। কুড়িগ্রাম জেলার বড় অংশ ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম অংশে পড়লেও রৌমারীর অবস্থান ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপাশে জামালপুর জেলার সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে। চাঁদপুর জেলার ইব্রাহিমপুর ইউনিয়ন মেঘনা নদীর পশ্চিম পাশে শরীয়তপুরের সঙ্গে সংযুক্ত। অথচ চাঁদপুরের অবস্থান মেঘনা নদীর পূর্ব অংশে। তবুও ঐতিহাসিক কারণে ইব্রাহিমপুর চাঁদপুর জেলারই অংশ।

thumbnail_Screenshot_2025-04-17-11-08-52-92_a27b88515698e5a58d06d430da63049d

ভাসানচরকে সন্দ্বীপ যেভাবে দাবি করে

thumbnail_Screenshot_2025-04-19-11-45-30-65_a27b88515698e5a58d06d430da63049d

১৯৯২ সালে সন্দ্বীপের ন্যায়ামস্তি নামের ইউনিয়নটি নদী ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। সে স্থানে জেগে ওঠা নতুন চরটি সন্দ্বীপবাসী তাদের বলে দাবি করে। এবং চরটি বর্তমান সন্দ্বীপ থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার বলে দাবি করেন তারা। সন্দ্বীপের জনৈক সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির এক আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত নির্বাহী বিভাগের প্রতি জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিগত সরকারের পতনের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার সরকারি কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। গত ৯ মার্চ এই কমিটির প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) ও আরএস জরিপ এবং স্যাটেলাইট ইমেজ পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগ ভাসানচরকে চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার ভূমি বলে প্রতিবেদন জমা দেয়।

thumbnail_IMG20250419174012

এর প্রতিবাদে হাতিয়ার সব শ্রেণি পেশার মানুষ বিক্ষোভ-সমাবেশ শুরু করে। সন্দ্বীপের বাসিন্দা ও উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান হাতিয়ার জায়গা নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে বলে তার পদত্যাগও দাবি করেন। রাজধানী, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলা সদরে এ আন্দোলন ও মানববন্ধন অব্যাহত রাখে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কাছে এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে হাতিয়ার কারীমুল হাই নাঈম এক প্রতিনিধি দলসহ একটি স্মারকলিপি দেন। চলতি মাসের ১০ এপ্রিল সীমানা জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও হাতিয়ার বাসিন্দা আবদুল হান্নান মাসুদ সীমানা নিষ্পত্তির বিষয়টি আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব দেন।

thumbnail_IMG-20250419-WA0009

এছাড়া, ভাসানচরকে হাতিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে অন্তর্ভুক্ত না করতে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশও দেয়। ১৭ এপ্রিল ‘নিরাপদ নোয়াখালী চাই’ সংগঠনের সভাপতি সাইফুর রহমান রাসেলের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশিদা চৌধুরী নীলু চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলা প্রশাসককে এ  নোটিশ পাঠান।

IMG-20250415-WA0005

‘সচেতন নাগরিক সমাজ-হাতিয়া’ নামক সামাজিক সংগঠনটির দাবি- নোয়াখালী বনবিভাগ যখন এ চর ভূমিকে গেজেটভুক্ত করতে এর অবস্থান ও সীমানা নির্দিষ্ট কারণে ০৪ মাসের যে একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়ে নোটিশ আহ্বান করেছিল। তখন তো সন্দ্বীপের কেউ প্রামানিক দলিলপত্র নিয়ে এর দাবি করেনি। দিয়ারা জরিপ চলাকালীন মৌসুমেও সন্দ্বীপের কেউ তাদের বলে দাবি করেনি। মীমাংসিত এ বিষয় নিয়ে সন্দ্বীপ এখন কেন বিতর্ক আর ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে- তা বোধগম্য নয় বলে উল্লেখ করেন সামাজিক এ সংগঠনটি।

IMG-20250408-WA0006

ভাসানচরের সীমানা বিতর্ক'র বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড.মো: জিয়াউদ্দীনের সাথে মোবাইল ফোনে  কথা হলে তিনি জানান, দিয়ারা জরিপে ভাসানচর হাতিয়ার সীমানায় পড়ার বিষয়ে ভূমি জরিপ শাখায় পত্র পাঠানো হয়েছে। তবে ২০১২ সালে ভাসান চরটি নোয়াখালী বনবিভাগেরও যে গেজেটভুক্ত হয়েছে- তা কেউ আলোচনা করেনি, মিটিংয়েও উপস্থাপন করেনি বলে জানান বিভাগীয় কমিশনার।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর