রোববার, ১৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

বিলুপ্তির পথে চুয়াডাঙ্গার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

আব্দুল হাকিম
প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৫৩ এএম

শেয়ার করুন:

বিলুপ্তির পথে চুয়াডাঙ্গার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
চুয়াডাঙ্গার কালুপোল গ্রামে রাজার ভিটায় পাওয়া প্রাচীন নিদর্শন | ছবি : সংগৃহীত

চুয়াডাঙ্গার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঐতিহাসিক কালুপোলের রাজার ভিটাকে ঘিরে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। রাজার ভিটার ইতিহাস ও স্থানকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পর্যটনস্পট। তবে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে সে সম্ভাবনা। চুয়াডাঙ্গার ইতিহাসের পাতা থেকে হারাতে পারে একটি অধ্যায়। ৪ বছর আগে খননকাজ শেষ করে সে স্থান থেকে বেশ কিছু প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া গেলেও সেসব নিয়েও নেই কোনো কার্যকর তৎপরতা। ফলে সুলতানি আমলের প্রত্নবস্তুও অবহেলা অযত্নে তার জৌলুস হারাচ্ছে। সেখানে একটি নামমাত্র যাদুঘর থাকলেও সবসময় বন্ধ পড়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুঁটে আসা পর্যটকরা ঐতিহাসিক স্থানটি কয়েক মিনিটে দেখে হতাশা নিয়ে ফিরে যান। তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে— ইতিহাস টিকিয়ে রাখতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার গড়াইটুপি ইউনিয়নের কালুপোল গ্রামের চিত্রা নদীর পাড় ঘেঁষে গন্ধর্ব রায় রাজার ভিটার সন্ধান মেলে। সরোজগঞ্জ ও কালুপোল সড়ক সংলগ্ন কালুপোল বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ ও পশ্চিম কোণে এ ভিটার সন্ধান মেলে। সেখানকার রাজার ভিটা খনন করে দুটি স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। খননকাজ শেষ হলেও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রাজার ভিটায় নেই কারও সুনজর। একটি ঘর বিশিষ্ট জাদুঘর থাকলেও তা সবসময় বন্ধ পড়ে থাকে। দেখভালের জন্য একজন প্রহরী নিয়োজিত রয়েছে। একহাতে তিনিই সবকিছুর সামাল দিচ্ছেন। দুটি স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষের দেয়ালের ইটগুলো খুলে পড়ছে। সীমানা প্রাচীর না থাকায় মানুষের অবাধ চলাচল ও গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে পুরো জায়গাটি। দুয়েকজন পর্যটকের সাথে দেখা মেলে সেখানে। তবে কালুপোল রাজার ভিটা পরিদর্শন করার পর হতাশা প্রকাশ করেন তারা।


বিজ্ঞাপন


তথ্যমতে, ১৪-১৫ শতকের সুলতানি আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধানে রাজার ভিটা নামক প্রত্ন ঢিবির শনাক্ত হয়। ২০১৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদফতর খনন করে দুটি স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তু পায়। সুলতানি আমলের প্রত্নবস্তু পাওয়া যায় ইমারতের দেয়াল, পোড়ামাটির তৈজসপত্র হাড়ি, ঘট, থালা, বাটি, কলস, তৈলপ্রদীপ, প্রদীপদানি, ধূপতি, মটকা, গণনার টোকন, শিল-নোড়া, অলংকৃত ইট, চুড়ি, কড়ি। স্বল্প মূল্যমানের পাথরের গুটিকা, ফলক, বাটখারা, পাথরের পুথি, মৃৎপত্র পাওয়া যায়। মধ্যযুগের সুলতানি আমলের শহর খলিফাতাবাদ (বাগেরহাট) ও মুহাম্মাদাবাদ (বারবাজার) প্রত্নস্থানে প্রাপ্ত স্থাপত্যিক নিদর্শন ও প্রত্নবস্তুর সাথে রাজার ভিটার সাদৃশ্য মিল রয়েছে। সুলতানি আমলের প্রত্নবস্তুগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। 

গন্ধর্ব রায় রাজা সম্পর্কে ইতিহাস গ্রন্থে তথ্য না থাকলেও স্থানীয়রা এটিকে রাজার ভিটা নামেই জানেন। চার আউলিয়ার অন্যতম হযরত মালেক উল গাউসের সাথে গন্ধর্ব রায় রাজার যুদ্ধ হয়। হযরত মালেক উল গাউস প্রখ্যাত সাধক হযরত খানজাহান (র.) এর সহচর ও অনুসারী ছিলেন। জানা যায়, গন্ধর্ব রায় রাজা ১৪-১৫ শতকের দিকে খানজাহান (র.) এর সমসময়িক কোনো আঞ্চলিক রাজা বা শাসক ছিলেন। এ যুদ্ধে গন্ধর্ব রায় পরাজিত ও নিহত হন।

এমন এক ইতিহাসের স্বাক্ষী রাজার ভিটার খনন কার্য শেষ হলেও সংরক্ষণের অভাবে তা বিলুপ্তির দারপ্রান্তে। হারিয়ে যাবে একটি ঐতিহাসিক স্থান। কালুপোল রাজার ভিটা আধুনিকায়ন ও সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে এবং পর্যটকদের সমাগম ঘটবে। অল্প সংখ্যাক পর্যটক রাজার ভিটা দেখতে এলেও হতাশ হয়ে ফিরে যান। সীমানা প্রাচীর, নতুন সড়ক নির্মাণ, পর্যটকদের বিশ্রামের স্থান, ছাওনি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, টয়লেটসহ অন্য জিনিসগুলো প্রয়োজন। স্থানীয়রা অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হবে। বদলে যাবে এখানকার দৃশ্যপট।

দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গা থেকে আসা পর্যটক ফারহান মাসুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থানটি দেখতে বন্ধুদের নিয়ে এসেছি। এখানে পর্যটকদের জন্য সকল ব্যবস্থা থাকা উচিত। অনেকের কাছ থেকে শুনে এখানে এসেছিলাম। আসার পর হতাশ হলাম। 


বিজ্ঞাপন


সদর উপজেলার গহেরপুর গ্রামের ইয়ামিন হোসেন ঢাকা মেইলকে জানান, জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকলে ঘুরে দেখা যেত। আর যা কিছু আছে সবই খালি পড়ে আছে। যেন দেখভালের কেউ নেই এখানে। 

গড়াইটুপি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম রাজু ঢাকা মেইলকে বলেন, রাজার ভিটার ইতিহাস আছে। রাজাদের বসবাস ছিল। তার ইতিহাস খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। সৌন্দর্য বর্ধন করা গেলে মানুষের মাঝে আগ্রহ তৈরি হবে। দেশ-বিদেশের মানুষ ইতিহাস জানবে সহজে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা হবে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শামীম ভূইয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, কালুপোল রাজার ভিটা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তালিকাভুক্ত সম্পদ। এখানে রাজা ও তার দুই মেয়ের করুণ কাহিনীর ইতিহাস রয়েছে। রাজার ভিটা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের একটি ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে। এ ইতিহাসটি সবাইকে জানাতে চাই। পর্যটকদের সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এ ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। 

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর