আজ ৪ এপ্রিল, যশোর গণহত্যা দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধে যশোরের ইতিহাসের নৃশংসতম দিনগুলোর অন্যতম। ১৯৭১ সালের এই দিনে যশোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রাককালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা শহরজুড়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে এদিন পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন যশোরের রাজনীতিক, শিক্ষক, ছাত্র ও পেশাজীবী ও ধর্মীয় নেতারা।
সেইদিনের গণহত্যায় ৫১জনের নিহতের কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি ছিল। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর গত বছর (২০২৪) ২৪ মার্চ কয়েকজনকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। তবে বাকিরা পাননি কোনো স্বীকৃতি। নেই কোনো স্মৃতিস্মারকও। ওই দিনের শহীদদের স্বীকৃতির দাবিতে বছরের পর বছর ঘুরছেন স্বজনরা।
বিজ্ঞাপন
সূত্র মতে, সারাদেশের মতো যশোরেও ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ প্রস্তুতি। আর এপ্রিলের শুরু থেকেই গোটা বাঙালি জাতি পুরোদমে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতিতে মাঠে নেমে পড়ে। এই যুদ্ধপ্রস্তুতিকে থামিয়ে দিতে নৃশংস হয়ে ওঠে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। এসময় যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাক আর্মি শহরের বিভিন্ন স্থানে চালাতে থাকে বর্বরোচিত হামলা। যশোরে তাদের সবচেয়ে নৃশংসতম হামলার ঘটনাগুলোর অনেকগুলোই ঘটে ৪ এপ্রিল। এদিন যশোর ক্য্যান্টনমেন্টের পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালায়। প্রকাশ্যে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে এদিন তারা হত্যা করে অর্ধশতাধিক বাঙালিকে। এদিন সবচেয়ে বড় ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে যশোর রেলস্টেশন মাদরাসা প্রাঙ্গণে।
সেদিনের সেই নারকীয় তাণ্ডবে বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী রেলস্টেশন এলাকার শেখ আব্দুর রহিম জানান, ৪ এপ্রিল ভোরে শহরের রেলস্টেশন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ফজরের নামাজ শেষ করে কোরআন শরীফ পাঠ করছিলেন। এমন সময় স্থানীয় বিহারীদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মাদরাসা প্রাঙ্গণে তাণ্ডব চালায়। মাদরাসার বড় হুজুর আবুল হাসান যশোরী পাক আর্মিদেরকে নিরস্ত করতে গেলে অবাঙালিরা পাক আর্মিদের জানায়, এরা সবাই ইপিআর; পাকিস্তানের শত্রু। এরপরই পাক আর্মি নির্বিচারে গুলি চালায়। মাদরাসা প্রাচীরের ওপর থেকে এই দৃশ্য দেখে পালিয়ে যান আব্দুর রহিম। পরে দুপুরের দিকে তিনি এবং তার ভাই জাহাঙ্গীর মাদরাসা প্রাঙ্গণে এসে দেখেন রক্তে ভেসে যাওয়া গোটা অঞ্চলে শুধু লাশ আর লাশ। এখানেই পাওয়ায় ২৩ জনের মৃতদেহ। এদের মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও বাকি ৭জনের পরিচয় আজও জানা যায়নি।
মাদরাসা প্রাঙ্গণে আত্মরক্ষার জন্য খোঁড়া গর্তে রহিম ও জাহাঙ্গীর লাশগুলো একের পর এক সাজিয়ে মাটিচাপা দেন। সেদিনের নৃশংস ঘটনাটি বর্তমানে মাদরাসা ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। এখানে নিহতদের যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা হলেন একই পরিবারের তাহের উদ্দিন, এবিএম আব্দুল হামিদ ও এবিএম কামরুজ্জামান এবং একই এলাকার কাজী আব্দুল গণি ও তার ছেলে কাজী কামরুজ্জামান। একই পরিবারের ৩ সদস্য তৎকালীন খুলনা কমিশনার অফিসের কর্মচারী দীন মোহাম্মদ, সম্মিলনী স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব হোসেন ও কাজী আব্দুল কালাম আজাদ, রেলস্টেশন মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান ওরফে কাঠি হুজুর, শহীদ সাংবাদিক গোলাম মাজেদের বাবা যশোর জিলা স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রউফ, শহর আলীর ছেলে আবু কালাম এবং মাদরাসার ছাত্র আতিয়ার রহমান, নোয়াব আলী, লিয়াকত আলী, মাস্টার আব্দুর রফিক ও আক্তার হোসেন।
বিজ্ঞাপন
একইদিনে শহরের গুরুদাসবাবু লেনেও চলে পাক হানাদারদের নারকীয় তাণ্ডব। এই লেনের বাড়ি থেকে অ্যাড. সৈয়দ আমীর আলী ও তার তিন ছেলে এমএম কলেজের বিকম শেষ বর্ষের ছাত্র সৈয়দ নুরুল ইসলাম বকুল, বিকম শেষ বর্ষের ছাত্র সৈয়দ শফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থী আজিজুল হককে পাক সেনারা ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে নির্মম নির্যাতনের পর তাদেরকে হত্যা করে। এদিনেই পাক সেনারা শহরের ক্যাথলিক গির্জায়ও আক্রমণ করে। সেখানে গির্জার ইতালিয়ান ফাদার মারলো ভারনেসিসহ ৬ জনকে হত্যা করে হায়েনারা।
এদের মধ্যে ২০২৪ সালে রেলস্টেশন মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান ও জিলা স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রউফ ও অ্যাড. সৈয়দ আমীর আলী শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন।
এছাড়াও একইদিনে শহরের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন তৎকালীন যশোর শহর ছাত্রলীগের সভাপতি এমএম কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এমএম কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মোছাদ্দেদ আলী, ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক, নিখিল রায়, নাসিরুল আজিজ, অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলী, তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট রহমতউল্লাহ, ইপিআর সদস্য আব্দুল মান্নান, ক্রিকেটার স্বপন বিশ্বাস, ডা. নাসির উদ্দিন ও মিসেস নাসির, আব্দুর রহমান, লুৎফর রহমান, মিসেস জাবেদা লুৎফর, চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ, মাহবুব এবং ভোলাট্যাংক রোডের অবসরপ্রাপ্ত সেরেস্তাদার আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী।
এ প্রসঙ্গে শহিদ অ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর আলীর ছেলে সাংবাদিক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন আলম বলেন, আমার বাবা ও তিনভাইকে সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির নাম ফলকে শহীদ আইনজীবীর তালিকায় আমার বাবার নাম রয়েছে। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী। এই স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে তারা লড়াই করেছেন। অবশেষে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় তার বাবার নাম স্থান পেয়েছে। ৫৩ বছর পরে হলেও স্বীকৃতি মেলায় তিনি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।
তবে কয়েকজন স্বীকৃতি পেলেও যশোরের গণহত্যা দিবসের অন্য শহীদদের স্বীকৃতি বা কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।
এ প্রসঙ্গে যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল বলেন, গণহত্যার শিকার শহীদদের স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিনের। এছাড়া যশোরের গণহত্যা দিবসের কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মারক নেই। তিনি কবর সংরক্ষণ, শহীদদের স্বীকৃতি ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান।
প্রতিনিধি/এসএস