সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের খোলপেটুয়া নদীর ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের ভাঙনকবলিত এলাকা তিন দিনেও সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি। এখন পর্যন্ত আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট, বল্লভপুর, আনুলিয়া, নয়াখালী, চেঁচুয়া, কাকবসিয়া, পারবিছুট ও বাসুদেবপুর গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া আংশিক প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা কমপক্ষে ৮টি। পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন ১৫ হাজার মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে ২০০ বিঘা জমির ধান, ৪ হাজার বিঘার অধিক চিংড়ি ঘেরসহ প্রায় ৮ শতাধিক বসতবাড়ি।
এর আগে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন সোমবার (৩১ মার্চ) পৌনে ৯টার দিকে সাতক্ষীরা বিছট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশ থেকে খোলপেটুয়া নদীর ২০০ ফুট এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধ হঠাৎ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। স্থানীয় গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে টানা তিন দিন ভাঙন পয়েন্টে বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। একের পর এক গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
ফলে গত তিন দিনেও বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় ইতোমধ্যে হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। প্লাবিত এলাকার সহস্রাধিক মানুষ বর্তমানে বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, এবং গৃহস্থালির মালামাল নিয়ে এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন।
আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, বাঁধ ভেঙে প্রবল জোয়ারের পানি গ্রামগুলোর ২০০ বিঘা জমির ধান ও ৪ হাজার বিঘার অধিক চিংড়ি ঘের তলিয়ে দিয়েছে। প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ বাড়িঘর পানির নিচে ডুবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মানুষ এখন দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ভাঙনের পরপরই গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বিকল্প রিং বাঁধ তৈরির চেষ্টা করলেও, প্রবল জোয়ারের তোড়ে সেই বাঁধও ধসে পড়ে। ফলে নতুন করে আরও বেশি এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাছের ঘেরে নদীর লবণ পানি প্রবাহের জন্য বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে তলা দিয়ে পাইপ বসানোর কারণে বাঁধের নিচের মাটি দুর্বল হয়েছিল। যে কারণে আস্তে আস্তে তলার মাটি ক্ষয়ে যাওয়ায় হঠাৎ করে বেড়িবাঁধ ধসে পড়ে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে বিছট গ্রামের ভাঙন পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধের ভাঙন পয়েন্ট দিয়ে প্লাবিত এলাকার পানি খোলপেটুয়া নদীতে নামছে। পানির স্রোতের সাথে ভাঙছে ল্যান্ড সাইডের ভূমি। স্থানীয় উদ্যোগে কয়েকশ মানুষ ভাঙন পয়েন্ট থেকে বেশ কিছু দূরে মাটি ও বালির বস্তা দিয়ে রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। তবে দুপুরের জোয়ার শুরু হলে ভাঙন পয়েন্ট দিয়ে ফের প্রবল বেগে পানি ঢোকা শুরু করে লোকালয়ে। ফলে আরও নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভয়ে বিছট গ্রামের অনেকে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। মাটির ঘর ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় অনেকে মালপত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। বুধবার দুপুরের জোয়ারে প্লাবিত গ্রামগুলোর নিম্নাঞ্চলের অনেক বাড়িতে নতুন করে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে অনেক মিষ্টি পানির পুকুর।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন—
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিছট গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও পাউবো কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণে ভাঙন মেরামতের কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। কিভাবে কাজ শুরু করলে দ্রুত ভাঙন প্রতিরোধ করে একটি বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণ করা যাবে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কার্যকরী উদ্যোগ নেই, ফলে বিডম্বনা দীর্ঘায়িত হচ্ছে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের জন্য।
বিছট নিউ মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবু দাউদ জানান, বিছট গ্রামের যে স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙেছে, ওই স্থানটি দীর্ঘদিন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এছাড়া মূল যে পয়েন্টটি ভেঙেছে সেখানে একটি পাইপ লাইন ও গেট সিস্টেম ছিল। মাছের ঘেরে পানি তোলার জন্য পাউবো’র বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে হঠাৎ বাঁধটি ধসে যায়।
তিনি আরও বলেন, সোমবার ঈদের নামাজের সময় পৌনে ৯টার দিকে গ্রামবাসী জানতে পারেন, হঠাৎ বাঁধটি ধসে পড়েছে। আমরা গ্রামের কয়েকশ লোক দ্রুত ভাঙন পয়েন্টে পৌঁছে বাঁধটি সংস্কারের চেষ্টা করি। কিন্তু দুপুরের জোয়ারের সময় সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ভাঙন পয়েন্ট দিয়ে দ্রুত বেগে পানি ঢুকতে থাকে লোকালয়ে। বিদ্যালয়ের মাঠে খোলপেটুয়া নদীর পানি প্রবেশ করেছে।
আনুলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো. রুহুল কদ্দুস জানান, বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় গতকাল তাঁদের নির্ঘুম রাত কেটেছে। ঈদে তাঁর ইউনিয়নের মানুষ আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। ইতোমধ্যে বিছট, বল্লভপুর, আনুলিয়া, চেঁচুয়া, কাকবাসিয়া গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছে নয়াখালী গ্রাম। এসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। শতাধিক মাছের ঘের ভেসে গেছে। বোরো ধানের খেত তলিয়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে কাঁচা ঘর।
এদিকে, মঙ্গলবার সকালে জেলা প্রশাসক, ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত আশাশুনি আর্মি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধি ভেঙে যাওয়া বাঁধ ও প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং সংকট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা নেন।
বর্তমানে আশাশুনি ক্যাম্প থেকে দুটি প্যাট্রল টিম দুর্গত এলাকায় অবস্থান করে স্থানীয় লোকজন এবং প্রশাসনকে বাঁধ মেরামতের কাজে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছে। এছাড়া, ৫৫ পদাতিক ডিভিশন থেকে ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নের একটি দলকে বাঁধ মেরামতের জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছে।
অপরদিকে, বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কার করা না হলে আনুলিয়া ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী খাজরা ও বড়দল ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন জানান, ভাঙন কবলিত এলাকার ৩০০ মিটার এলাকায় রিং বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে। জোয়ারের কারণে কাজে কিছুটা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। নদীতে ভাটা শুরু না হলে কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। বুধবার, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার কাজ চলবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘ঈদের কারণে শ্রমিক সংকট ও বালু বোর্ড আনতে দেরি হওয়ায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে। আমি মঙ্গলবার সকালেই ঘটনাস্থলে এসে দেখেছি, পরিস্থিতি ভয়াবহ।’
তিনি আরও বলেন, ‘জোয়ারের পানির কারণে বুধবার সকাল থেকে কাজ করা সম্ভব হয়নি। তবে বুধবার সন্ধ্যা থেকে সারারাত কাজ চলবে। আশা করি, বৃহস্পতিবারের মধ্যে কাজ শেষ হবে। এছাড়া আক্রান্ত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তালিকা অনুযায়ী তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।’
প্রতিনিধি/একেবি