শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

রূপকথার গ্রাম চক-চান্দিরায় ৩৬৫ পুকুর

সুমন আলী
প্রকাশিত: ১২ জুন ২০২২, ১১:০১ এএম

শেয়ার করুন:

রূপকথার গ্রাম চক-চান্দিরায় ৩৬৫ পুকুর
ইসবপুর ইউনিয়নের চক-চান্দিরা গ্রাম (পাখির চোখে)

রূপকথার গ্রাম চক-চান্দিরা। অষ্টম শতাব্দীর পাল বংশের কোনো এক রাজার রাজ্য ছিল এই খানে। রাজপ্রসাদ, সৈন্য, রাজকার্য আর রানী নিয়ে খুব সুখেই দিন কাটছিল তার। কিন্তু হঠাৎ কী এক অসুখে পড়লেন রানী। কিছুতেই সে অসুখ আর ভালো হয় না। দিন দিন শুধু রানীর স্বাস্থ্যের অবনতিই হচ্ছিল। রাজার মনে শান্তি নেই। রাজপ্রসাদ থেকেও উধাও হলো সুখও। সারারাজ্যে এলান করা হলো রানীর অসুখ সারানোর জন্য। রাজ্যের যত হেকিম, বৈদ্য সবাই এলেন রাজ সভায়। তারপর এক হেকিম জানালেন, রানীর অসুখ ভারী কঠিন। সারতে হলে রাজাকে ৩৬৫টা পুকুর খনন করতে হবে। আর বছরের এক এক দিন রানী এক এক পুকুরে গোসল করবেন। বছরের ৩৬৫ দিন ওই ৩৬৫ পুকুরে গোসল করলে, তবেই সুস্থ হবেন রানী। এরপর রাজা তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য রাজ্যে এই ৩৬৫ পুকুর খনন করেন। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই রাজা, রাজ্য আর রাজপ্রসাদ। কিন্তু মানুষের মুখে মুখে আজও রয়ে গেছে সেই লোকগাঁথা।

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নের এই গ্রামে পৌঁছেই চোখে পরবে বিশাল এক বিল। নাম তার ঘুকশির বিল। বিলের পাশে সারি সারি পুকুর। সামনে খানিকটা এগুতেই আরও কিছু পুকুর। বলতে গেলে সারা গ্রাম জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই ৩৬৫ পুকুর। স্থানীয়রা এই জায়গাটিকে বলে তিনশতিনা। একসাথে পাশাপাশি ৩৬৫ পুকুর কালের সাক্ষী হয়ে এখনো রয়েছে এখানে। এখানে রাজার রাজপ্রসাদ বা অন্য কোনো কিছুর ধ্বংসাবশেষ কিছুই চোখে পড়েনি। সেজন্য সেখান থেকে জানাও যায়নি সেগুলোর সঠিক ইতিহাস। হয়তো শুধু পুকুরগুলোই সেই কথিত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।


বিজ্ঞাপন


dhuroil

কথা হয় ওই গ্রামের বাসিন্দা মুরশেদুল আলম মুর্তুজার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এটি ইতিহাসের বিরল একটি ঘটনা। কারণ এখানে ৩৬৫ পুকুর একই সঙ্গে অবস্থিত। অষ্টম শতাব্দির পাল বংশের কোনো এক রাজা এখানে বসবাস করতেন। সেসময় সেই রাজার স্ত্রী অসুস্থ হলে এক হাকিমের আসেন। সেই হাকিম তাকে ৩৬৫ পুকুর খনন করতে বলেন এবং সেসব পুকুরে একদিন একদিন করে গোসল দিলে তার স্ত্রী সুন্থ হবেন বলে জানান। সেই শর্তে ওই রাজা এসব পুকুর গুলো খনন করেন। আজও পুকুর গুলো দৃশ্যমান। বাবা-দাদা ও স্থানীয়দের কাছ থেকে এসব শুনেছি। তবে সেই রাজার নাম ও অন্য কোনো ইতিহাস জানি না।’

একসাথে ৩৬৫ পুকুরের গল্প লোকমুখে শুনে শুক্রবার বিকেলে সেখানে ঘুরতে আসেন শিক্ষক আসাদুর রহমার। তিনি বলেন, ‘একসঙ্গে এতোগুলো পুকুর একবারে দেখা সম্ভব না। এরপরও যতটুকু দেখেছি। ভালো লাগলো। এছাড়া এখানে প্রাকৃতিক বনায়ন আছে। যা এখানকার পরিবেশকে আরও আকর্ষণীয় করেছে। এর প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটন করে এটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।’

চান্দিরা গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলামের বয়স প্রায় ৮০ ছুঁই ছুঁই। পুকুরগুলোর ইতিহাস জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম জানান, রাজা রানীর এই কাহিনী প্রায় সবার জানা। কালের বির্বতনে কিছু পুকুর ভরাট হয়েছে। আদিকাল থেকে সেগুলো তিনি দেখছেন। তার বাবা- দাদারাও এর পুরো ইতিহাস জানতেন না। তারাও লোকমুখে এই কথাই শুনেছেন।


বিজ্ঞাপন


dhuroil

নজরুল ইসলামের মতো আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের। তারাও রাজা-রানী ও সেই ইতিহাসের কথা জানালেন। তবে বর্তমানে পুকুরগুলোর কিছু অংশ সরকারিভাবে লিজ দেওয়া হয়েছে এবং বনায়ন করা হয়েছে। এখন সেগুলো লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছেন স্থানীয়রা।

আরেক দর্শনার্থী রাসেল মাহমুদ বলেন, ‘এখানকার ইতিহাস আমিও শুনেছি।  ঘটনা যাই হোক, এখানে এক সঙ্গে এতোগুলো পুকুর আদিকাল থেকে আছে। তার মানে এটি একটি বিরল ঘটনা। এটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে এলাকার উন্নয়ন হবে।’

উপজেলার সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুল মালেক বলেন, ‘আমরা জেনেছি, এই ৩৬৫ পুকুর পাল রাজার সময় খনন করা হয়েছে। এরকম একসঙ্গে এতোগুলো পুকুর দেশের কোথাও নেই। পুকুরগুলোর কিছু অংশ সরকারিভাবে লিজ দেওয়া হয়েছে এবং চারপাশে বনায়ন করা হয়েছে। ইতিহাতের সাক্ষী হয়ে থাকা পুকুরগুলোকে সরকারিভাকে সংরক্ষণ করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানাই।’

dhuroil

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হবে। এতে এলাকার উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি পর্যটকদের বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত পাবে এই এলাকা।’

ধামইরহাট এমএম ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও গবেষক মো. শহিদুল ইসলাম জানান, এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক প্রাচীনকালের অনেক নিদর্শন। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে চক চান্দিরার ৩৬৫ পুকুর। প্রাচীনকালের সাক্ষী এই দর্শনীয় স্থানটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি এলাকাবাসীর। সেই সঙ্গে এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থাও ভালো না। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করা হলে সেখানে অনেক পর্যটক আসবে। এতে করে এলাকার উন্নয়ন হবে। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

ধামইরহাট উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) গনপতি রায় জানান, এই স্থানটিকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জেলা প্রশাসককে একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। তিনিও আশস্ত করেছেন, যত দ্রুত সম্ভব ওই এলাকা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

রাস্তাগুলোর বেহাল অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানান, ওই রাস্তাগুলোর উন্নয়নে স্থানীয় এমপিসহ জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে ওই এলাকার রাস্তাগুলোতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে এবং ওই এলাকা একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে।

টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর