বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

খোলা আকাশের নিচে এক প্লেটে ‘জামাতবদ্ধ ইফতার’

আমানুল্লাহ আমান, রাজশাহী
প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

রাজশাহীতে ৩১ বছর ধরে জামাতবদ্ধভাবে একই প্লেটে ইফতার করে আসছেন এক মাদরাসার শত শত শিক্ষার্থী। খোলা আকাশের নিচে দৈনিক প্রায় ৬০০ রোজাদার ইফতার করছেন একসঙ্গে। ভিন্নরকম এমন আয়োজন সাড়া ফেলেছে স্থানীয়দের মাঝেও। ফলে আশপাশের এলাকার প্রায় শ খানেক মুসলমান মাদরাসাটিতে রোজ ইফতার করতে আসেন।

জানা গেছে, নগরীর উপকণ্ঠ পবা উপজেলার কাটাখালি এলাকায় মাওলানা শায়েখ ইদ্রীস সন্দ্বীপী রহ. এর হাত ধরে জামিয়া উসমানিয়া হোছাইনাবাদ নামের এই মাদরাসাটি ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২০০২ সালে তিনি মারা গেলে তার ছাত্র আল্লামা জামাল উদ্দীন মাহমুদ সন্দ্বীপী মাদরাসাটির হাল ধরেন। প্রায় ১০ বিঘা জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটিতে দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত রয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দাওয়াত, তালীম ও তাযকিয়াহ তিন বিষয়ের সমন্বয়ে ধর্মীয় এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৭০০। প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠদান করানো হচ্ছে। শিশু থেকে দাওরা (মাস্টার্স) পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছেন। তাদের নিয়ে পুরো রমজান মাসজুড়ে দৈনিক ইফতারের পসরা বসে।

raj_Mad1

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাদরাসার সামনে টিনের ছাউনি ও খোলা আকাশের নিচে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পানির বোতল ও জগ সাজিয়ে রাখছেন শিক্ষার্থীরা। বোতল ও জগের নিচে ছোট ছোট সাইজে কাটা পলিথিন (দস্তরখানা) বিছিয়ে রাখছেন। আর ভেতরের কক্ষে বড় প্লেটে সারি করে ইফতারের খাবার সাজাচ্ছেন আরও কিছু শিক্ষার্থী। প্রতিটি প্লেটে খেঁজুর, পলিথিনে ঢুকানো মুড়ি, রান্না করা ছোলা, শশা, জিলাপি, পেয়ারার কাটা পিস ও পেঁয়াজু দেওয়া হয়েছে। পরে এক হাত দু হাত করে বাড়িয়ে দিয়ে সাজিয়ে রাখছেন বিছানো দস্তরখানার ওপর। তাদের এ সবকিছু তদারকি করছেন কয়েকজন শিক্ষক।

অবস্থান করে দেখা যায়, নামাজের কাতারসদৃশ সারি সারি করে ইফতারের প্লেটগুলো রাখার পর সেখানে একসঙ্গে বসে পড়লেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি প্লেটের চারপাশে গোল হয়ে ৫-৬ জন করে শিক্ষার্থী বসেন। এরপর শিক্ষকদের নির্দেশমতো আমল করতে শুরু করেন। এরপর ইফতারের পূর্বে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দীর্ঘক্ষণ দোয়া করলেন তারা। আজান দিলেন একজন। তখনই কাড়াকাড়ি একই প্লেটের খেঁজুর, ছোলা, মুড়ি ভাগাভাগি করে খেতে লাগলেন।


বিজ্ঞাপন


raj_Mad2

শিক্ষার্থীরা জানান, প্রতিবছর রমজান মাসে তারা এভাবে ইফতার করে থাকেন। এটি বেশ উপভোগও করেন তারা। এতে ভালবাসা বৃদ্ধি পায় তাদের পরস্পরের মধ্যে। মো. আব্দুল্লাহ ৭ বছর ধরে মাদরাসটির কিতাব বিভাগে পড়ালেখা করছেন।

তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, মাদরাসায় থাকাকালীন সারাদিনের মধ্যে ইফতারের সময়টিতে বেশ আনন্দ উপভোগ করে থাকি। আসরের পর থেকে কোরানের দাওর, তারপর যিকির হয় কিছুক্ষণ। এরপর একেবারে ইফতারের সন্ধিক্ষণে সম্মিলিত মুনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। আমরা সবাই এক সঙ্গে এই পর্বগুলোতে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে অংশগ্রহণ করি। একই খাঞ্চায় (প্লেটে) ৫/৬ জন একসাথে খাওয়ার মজাই আলাদা। শেষ দশকে বাড়িতে থাকা অবস্থায় মাদরাসার ইফতারের আয়োজনকে অনেক মিস করি।

ইফতা বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী হাসানুল বান্না। মকতব, হিফজ, কিতাব ও আরবী সাহিত্য বিভাগের গন্ডি পেরিয়ে তিনি বর্তমানে পড়ালেখা করছেন ফতোয়া নিয়ে। হাসানুল বান্না ঢাকা মেইলকে বলেন, ছোটকাল থেকে দেখে আসছি- আমাদের মাদরাসায় রমজানের প্রতিটি দিনে ইফতারের আয়োজন হয়ে থাকে। কখনো কখনো এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে ইফতার মাহফিলেরও আয়োজন হয়ে থাকে। তখন এক সঙ্গে কয়েক হাজার লোকের উপস্থিতিতে ইফতার করতে আমার বেশি ভালো লাগে।

raj_Mad4

তিনি বলেন, সবার সামনে সাজানো থাকে হরেক রকমের খাবার কিন্তু কেউ খায় না। আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী অপেক্ষা করে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সবাই খেতে শুরু করে। এই দৃশ্য দেখে কী যে আনন্দ লাগে, তা বলে বুঝাতে পারবো না। বড় বড় প্রোগ্রামগুলোতে আমি পরিবেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকি। পানি বা শরবত নিয়ে দস্তরখানের কাছে গিয়ে গিয়ে সবার গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে দেই। এ এক ধরনের ভিন্ন আত্মতৃপ্তির কাজ। আমি বেশ উপভোগ করি।

মাদরাসাটির শিক্ষকরা জানান, ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের ইফতার আয়োজনের নজির রয়েছে। সেজন্য প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ওই মাদরাসায় এভাবে ইফতার হয়ে আসছে। হাফেজ মাওলানা মোশাররফ হোসেন মাদরাসাটির শুরুর দিকের ছাত্র ছিলেন। তিনি বর্তমানে ওই মাদরাসার হিফজ বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।

মাওলানা মোশাররফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের প্রধান মুহতামিম উদ্যোগ নিয়ে এটা চালু করেছেন। সম্মিলিতভাবে নবীজীর সাহাবিরা ইফতার করতেন। তাই বলা যায় এটা সুন্নাত। এক সঙ্গে অনেকে ইফতার করলে কোনো বৈষম্য থাকে না। ইফতার সময়টা বেশ আনন্দের, এ আনন্দ পূর্ণতা পায়।

মাদরাসাটির মুহাদ্দিস মাওলানা হোছাইন আহমাদ আযমী ঢাকা মেইলকে বলেন, ছাত্রদের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। তারা প্রতিদিন দস্তরখানা বিছিয়ে, ২টি করে বোতল রেখে ইফতার সাজিয়ে নিজেরাই সুশৃঙ্খলভাবে এসব দায়িত্ব পালন করে। আমাদের এই আয়োজন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে।

এ বিষয়ে কাটাখালি জামিয়া উসমানিয়া হোছাইনাবাদ প্রিন্সিপ্যাল আল্লামা জামাল উদ্দীন মাহমুদ সন্দ্বীপী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এখানে জ্ঞানের পাশাপাশি আমলি পরিবেশ আছে। পুরো রমজান মাসজুড়েই আমাদের এখানে ইবাদত ও আমলের আবহ তৈরি হয়। আমাদের ৭৫ জন শিক্ষকসহ মোট ৮৫ জন স্টাফ এসব সাবক্ষণিক দেখভাল করেন। তাছাড়া উত্তরবঙ্গসহ সারাদেশের বিভিন্ন জেলার ছাত্ররা এখানে পড়ালেখা করতে এসেছেন। দস্তরখানা বিছিয়ে একপ্লেটে খাওয়া সুন্নাত। এতে পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়। ছাত্রদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও ভালবাসা বাড়ে। সেজন্য এভাবে আয়োজন করা হয়।

প্রতিনিধি/টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন