- ভোগ্যপণ্যে ভরে গেছে চট্টগ্রাম, কমেছে দামও
- বন্দরসীমায় কমেছে জাহাজ জটও
আমদানি পণ্য নিয়ে কর্ণফুলী নদীসহ পতেঙ্গা সমুদ্র অঞ্চলে ভাসছিল হাজার হাজার লাইটার জাহাজ। গত এক-দেড় মাস ধরে এভাবে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে ভোজ্যতেলসহ নানা পণ্য অধিক মূল্যে বিক্রি করে আসছিল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
বিজ্ঞাপন
পণ্যের দাম কমাতে কম চেষ্টা করেনি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। নির্ধারণ করে দিয়েছিল ভোজ্যতেলের দামও। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আর এ সময়ে ব্যবসায়ীদের পাকা ধানে মই দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।
সম্প্রতি জারি করা এক নির্দেশনায় পণ্য খালাস করে লাইটার জাহাজগুলোকে ত্যাগ করতে হচ্ছে বন্দরসীমা। এতে ভোগ্যপণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আসাদগঞ্জ ও রেয়াজউদ্দিন বাজার। কমেছে পণ্যের দামও।
বুধবার (১২ মার্চ) বিকেলে এ তথ্য জানান খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস মিয়া। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এক আদেশে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পাকা ধানে মই পড়েছে। কর্ণফুলী নদী ও সাগরে ভাসমান জাহাজগুলো পণ্য খালাসে বাধ্য হচ্ছে। এতে পণ্যে ভরে গেছে খাতুনগঞ্জসহ চট্টগ্রামের সবকটি ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার। কমে গেছে পণ্যের দামও।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ ও রেয়াজউদ্দিন বাজারে ভরে গেছে সয়াবিন তেল। ফলে গত সোমবার পর্যন্ত বোতলজাত সয়াবিন তেল যেখানে লিটার প্রতি ২১০ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হয়েছিল, সে তেল মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে লিটার প্রতি ১৮০-১৮৫ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪০ টাকা থেকে কমে ২৪ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে।
চাক্তাই ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন জানান, আমদানি পণ্য বোঝাইয়ের পর লাইটার জাহাজ যেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দরসীমা ত্যাগ করে এমন নির্দেশনা জারী করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সোমবার বিকেল থেকে যৌথ অভিযানে নামে কোস্টগার্ড।
এরপর শুরু হয় কর্ণফুলী নদীসহ পতেঙ্গা সমূদ্র অঞ্চলে ভাসমান লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাস। এতে মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে ভোগ্যপণ্যে পরিপূর্ণ হয়ে যায় খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, চাক্তাই, রেয়াজউদ্দিন বাজার। অন্যদিকে কর্ণফুলীসহ পতেঙ্গা সমুদ্র অঞ্চলে লাইটার জাহাজের অবস্থান কমে গেছে।
চবক নৌ-বিভাগের উপ-সংরক্ষক ক্যাপ্টেন মো. ফরিদুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, পণ্যবোঝাই যেসব জাহাজ বন্দরে আসে, সেগুলোর লোডিং-আনলোডিংয়ে তিন দিনের বেশি সময় লাগে না। তাই আমরা কেবল পণ্যবোঝাই জাহাজের জন্য এ নির্দেশনা দিয়েছি।
আমরা অতিরিক্ত সময় থাকা বা জাহাজে পণ্য গুদামজাত করাকে অনুৎসাহিত করি, তাতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। এ লক্ষ্যে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আমদানি পণ্য বোঝাইয়ের পর লাইটার জাহাজ যেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দরসীমা ত্যাগ করে। নির্দেশনা বাস্তবায়নে সোমবার বিকেল থেকে অভিযান চালায় কোস্টগার্ড।
কোস্টগার্ডের অভিযান নিয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির জাহাজ সবুজ বাংলার অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কমান্ডার সালমান সিদ্দিকী বলেন, বিশেষত ভোগ্যপণ্য ও ভোজ্যতেল নিয়ে আসা লাইটার জাহাজ যেন ৭২ ঘণ্টার বেশি বন্দরে না থাকতে পারে, এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি একটি নির্দেশনা দিয়েছে। সেটি নিশ্চিত করার জন্য আমরা যৌথ অভিযান পরিচালনা করছি।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত আমরা ১ হাজার ৮৫টি লাইটার জাহাজে বুট করেছি। আমরা তাদেরকে আহরণ করে নিশ্চিত করেছি তারা যেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের পণ্য নামিয়ে পরবর্তী গন্তব্যে চলে যায়। অভিযানে নৌ-পুলিশ, বিআইডব্লিউটিসহ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ছিলো।
তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থার বন্দর জোন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে যে পরিমাণ জাহাজ বহির্নোঙরে ও চ্যানেলে ছিল, এখন সেরকম জাহাজ নেই। বিশেষ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ অভিযান পরিচালনার পর থেকে জাহাজগুলো অতিরিক্ত সময় বহির্নোঙরে থাকছে না।
সূত্র মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা ও কর্ণফুলীর নতুন ব্রিজ এলাকা পর্যন্ত খালি লাইটার জাহাজ থাকলেও পণ্যবোঝাই কনটেইনারের সংখ্যা খুবই কম। মেরিন ট্রাফিকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী চ্যানেলে ২২টি এবং পতেঙ্গা থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল পর্যন্ত ৮৭টি কার্গো, কনটেইনার ও বাল্ক জাহাজ রয়েছে। এছাড়া তেলের ট্যাঙ্কার রয়েছে ৩৩টি, যা ক্রুড অয়েলসহ অন্যান্য তেল বোঝাই।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ন্য কমাতে বন্দর কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত খুবই কার্যকরী। তারা নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি অভিযানও পরিচালনা করছে। ফলে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি কেটে গেছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এ নির্দেশনা ও অভিযান আরও এক-দেড়মাস আগে কার্যকর করা উচিত ছিল। সে সময় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমদানি পণ্য নিয়ে হাজার হাজার লাইটার জাহাজ সাগরে ভাসার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দেরীতে হলেও চবকের এই নির্দেশনায় বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে যে সংকট ও সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা কেটে যাবে। এরপরও বিষয়টি প্রশাসনের আন্তরিকভাবে দেখা প্রয়োজন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে পারু বলেন, রমজান মাসে পৃথিবীর কোনো দেশে পণ্যের দাম বাড়ায় না। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের যেহেতু সদিচ্ছার অভাব আছে; তাই সরকার ও প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে চসিক মেয়র ও জেলা প্রশাসকের ভুমিকার প্রশংসা করেন জেসমিন সুলতানা পারু।
উল্লেখ্য, রমজানের পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরাসরি অভিযানে নামে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোছাম্মৎ ফরিদা খানম ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাৎ হোসেন। অভিয়ানে পণ্যের সংকট নিয়ে কারসাজি দেখতে পান তারা। এরপর ব্যবসায়ী-আমদানিকারকদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। সেখানে সকল পক্ষের সম্মতিতে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দেন।
সে অনুযায়ী, আমদানিকারকরা ১৫৩ টাকা, ট্রেডার্সে ১৫৫ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ১৬০ টাকা প্রতিলিটার খোলা তেল বিক্রি করার কথা। কিন্তু সে কথা কেউ রাখেনি। এরপর নির্দেশনা জারী করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরিচালনা করেন অভিযানও।
প্রতিনিধি/একেবি