রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী গরম ও মচমচে ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’ কিনতে ভিড় জমছে রোজাদারদের। ক্রেতাদের হুড়োহুড়িতে দম ফেলার সময় নেই কারিগর ও কর্মচারীদের। ইফতারপূর্ব মাত্র এক ঘণ্টায় দৈনিক প্রায় অর্ধলক্ষ টাকার জিলাপি বিক্রি হচ্ছে ব্যানার-সাইনবোর্ডবিহীন দোকানটিতে! চাপ সামলাতে মালিকের পরিবারের ক্ষুদে সদস্যরাও এসে সহযোগিতা করছেন কর্মচারী ও কারিগরদের।
জানা গেছে, ১৯৬০ সালে নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টের অদূরে বাটার মোড়ে একটি খুপরি ঘরে জিলাপি বিক্রি শুরু করেন সোয়েব উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী। ঘরটির নাম দেন ‘রানীবাজার রেস্টুরেন্ট’। পাশেই জুতার বাটা কোম্পানির শো-রুম। ফলে জায়গাটি বাটার মোড় হিসেবে নামকরণ হয়। আর জিলাপিতে সুখ্যাতি পান সোয়েব। তার নাম ছড়িয়ে পড়ে দ্রুতই। বাটার মোড়ের জিলাপি হিসেবে শহর পেরিয়ে নাম-ডাক বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে। জিলাপি ভাজতেন যামিনী সাহা নামে একজন হিন্দু নারী। আর বিক্রি করতেন সোয়েব।
বিজ্ঞাপন
যামিনী ১৯৮০ সালে মারা গেলে তার ছেলে কালিপদ সাহা জিলাপি তৈরি শুরু করেন। পরে তারও মৃত্যু হয়, ২০১৭ সালে। তবে মৃত্যুর আগে সাফাত আলীকে সাথে নিতেন তিনি। সাফাত শিখে নেন জিলাপি ভাজার কলা। এদিকে, দোকানের মালিক সোয়েব উদ্দিন মারা যান ২০০২ সালে। এরপর তার চার ছেলে সোহেল, হাসেম উদ্দিন, শামীম ও ইমরান আলী দোকানটি চালু রাখেন। সোয়েবের ৪ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সোহেল মারা গেছেন। বর্তমানে তার তিন ছেলে হাসেম উদ্দিন, শামীম ও ইমরান আলী দোকান চালাচ্ছেন।
বর্তমানে রমজানে দৈনিক কমপক্ষে ৫ মণ জিলাপি বিক্রি হচ্ছে তাদের। তাও সেটি ইফতারির পূর্বের মাত্র এক ঘণ্টা সময়ে। প্রতিকেজি জিলাপি ২২০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। তবুও ভিড় কমছে না মুহূর্তের জন্য। কারিগর সাফাত আলী চুলার পাশ থেকে এক সেকেন্ডের জন্য উঠার সময় পাচ্ছেন না। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সোয়েবের এক ছেলে ক্যাশ কাউন্টারে বসে টাকা নিচ্ছেন। আরেকজন জিলাপি শেষ হলে কর্মচারির সাথে জিলাপি ঢালছেন। আরেকজন কাস্টমার মেইনটেনেন্সের কাজ করছেন।
বিকাল সাড়ে ৫টায় ১০ বন্ধুকে নিয়ে জিলাপি কিনতে আসেন কলেজছাত্র শরিফুল। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাজশাহীর এমন কোনো মানুষ নেই যে বাটার মোড়ের জিলাপির স্বাদ নেয়নি। আমরা নিয়মিত খেতে আসতাম। এখন রোজার মাস, ইফতারিতে খাব, তাই বন্ধুদের সাথে নিয়ে কিনতে এসেছি। মেসে গিয়ে এই জিলাপি দিয়ে ইফতার করবো।’
আহম্মদ আলী নামে আরেক রোজাদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার বাচ্চাটা বাটার মোড়ের জিলাপির পাগল। আমার ডায়াবেটিস, তাই আমি খেতে পারি না। কিন্তু ছেলেটা খাবে, তাই কিনতে এসেছি। ১১০ টাকা দিয়ে হাফ কেজি কিনলাম।’
বিজ্ঞাপন
মোটরসাইকেল থামিয়েই ৫ কেজি জিলাপির অর্ডার দিলেন এক যুবক। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নামাজের পর মাঠে ভাই-ব্রাদাররা আড্ডা দিই। এই জিলাপিটা অনেক সময় ধরে মচমচে থাকে, তাই কিনে রাখলাম। পরে খাব।’
প্রধান কারিগর সাফাত আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি ৪২ বছর ধরে এখানে জিলাপি ভাজছি। জিলাপি তৈরি করতে চালের আটা, ময়দা ও মাষকলাইয়ের আটা ব্যবহার করি। আর সাথে ব্যবহার করি পামঅয়েল ও ডালডা। এখানে (এতে) অনেক কাস্টমার। চাহিদামতো তাও সেভাবে মাল (জিলাপি) দিতে পারি না। রোজা মাসে চাপ বেশি। সবাই আসে ইফতারি করবে, তাই ভিড় বেশি।’
প্রয়াত সোয়েব উদ্দিনের ছেলে হাসেম উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ব্যবসা এটা আব্বা শুরু করেছিলেন। তখন থেকেই মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়। আব্বার মৃত্যুর পর আমরা ৪ ভাই হাল ধরেছিলাম। বড় ভাই সোহেল মারা গেছেন। এখন আমরা তিন ভাই চালাচ্ছি। অন্য সময়ের চেয়ে রোজায় বেশি বিক্রি হয়।’

তিনি বলেন, ‘রমজানে দৈনিক ৫ মণ জিলাপি বিক্রি হচ্ছে। রমজান মাসে আমাদের এটা মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবসা, ইফতারির আগের এক ঘণ্টা। কাস্টমারের চাপ অনেক। সেজন্য কর্মচারী ছাড়াও ভাতিজারা এসে সহযোগিতা করছে। আমরা ২০ জন মতো লোক কাজ করছি। বাটার মোড়ের জিলাপির ঐতিহ্য ধরে রেখেই ব্যবসা পরিচালনা করা হবে।’
প্রতিনিধি/একেবি

