ভাষার জন্য যশোরেই প্রথম চলেছে গুলি; ঝরেছে রক্ত। ১৯৪৮ সালে ১৩ মার্চ ভাষার দাবিতে যশোরে রাজপথ যখন স্লোগানে স্লোগানে কম্পিত হতে লাগলো। সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। এতে রক্ত ঝরে যশোরে রাজপথে। মার্চের সেই দিনগুলো কথা উঠে এসেছে ভাষা নিয়ে গবেষণাকারীদের গবেষণায়।
যশোরের ভাষা আন্দোলনের গবেষক কবি সাইদ হাফিজ লিখেছেন, যশোরে ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে সংগ্রাম মুখর দিনটি হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ১৩ মার্চ। ওই দিনের ঘটনা শুধু যশোরে নয় পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে পর্যন্ত আলোচিত হয়েছিল। সেসময়ের পত্র-পত্রিকাগুলোয় ওই দিনের ঘটনা গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়েছিল। ছাত্র-নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে উদ্দীপ্ত প্রতিবাদ হিসেবে ওইদিন সকাল ৮টার মধ্যেই যশোর সরকারি এমএম কলেজ থেকে মিছিল বের হয়। শহরের সর্বস্তরের মানুষ এমন কী সরকারি কর্মচারীরাও অফিস ছেড়ে মিছিলে যোগ দেন। ওই মিছিলে রিকশাচালক, দোকানি ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রায় ৩ হাজার মানুষ অংশ নেন। ১১ মার্চ গ্রেফতারকৃতদের যে সময় আদালতে হাজির করা হয়। কালেক্টরেট ভবনে ঢুকতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ওসি ও কয়েকজন দারগার সাথে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চার্জ শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। নিয়াজ পার্কের প্রাচীর লাফিয়ে পার হওয়ার সময় পুলিশ ছাত্রদের পিঠে লাঠি দিয়ে প্রহার করেন। ছাত্ররা প্রাচীর পার হয়ে পুলিশের প্রতি বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ও ডাবের খোসা ছুঁড়তে শুরু করেন। শহরের শতশত রিকশাচালক লুঙ্গি ভরে ইটের টুকরো সরবরাহ করছিলেন। আর ছাত্ররা পুলিশ বাহিনীর প্রতি অবিশ্রাম বৃষ্টির মতো তা নিক্ষেপ করছিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খণ্ড খণ্ডভাবে ছাত্র-জনতা আবারও একত্রিত হন। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার একাংশ আকস্মিকভাবে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে ঢুকে পড়েন। ভাগ্যবশত তিনি তখন কক্ষে ছিলেন না। ছাত্র-জনতা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট নোমানীর অফিস ভাঙচুর শুরু করেন। পুলিশ সেখানেও লাঠিচার্জ করে তাদের হটিয়ে দেন। তারা কালেক্টরেট ভবনেও হামলা চালান। ইটের আঘাতে কালেক্টরেট ভবনের দরজা-জানালার গ্লাস ভেঙে যায়। জনতা-পুলিশ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত জনতার ইটের আঘাতে যশোর কোতয়ালী থানার ওসি আবদুল জব্বারের কান ছিঁড়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ধরাধরি করে কোর্ট দারোগার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। আহত হন বহু পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেন। ব্রিটিশ সরকারের ফেলে যাওয়া অস্ত্র প্রথমবারের মতো তাদের এদেশিয় অনুসারীরা হাতে তুলে নেন এবং জনতার দিকে উঁচিয়ে ধরেন। একপর্যায়ে কালেক্টরেট ভবনের সর্ব পূর্বের ট্রেজারি থেকে প্রচণ্ড শব্দে ছুঁটে আসে রাইফেলের গুলি। ট্রেজারির বারান্দা থেকে উত্তর ও পূর্বদিকে এক নাগাড়ে ফাঁকা গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। জনতার দিকে তাক করেও কিছু গুলি ছোড়া হয়। এসময় ছাত্রনেতা আলমগীর সিদ্দিকী পায়ে গুলি লেগে আহত হন।
ভাষার জন্য যশোরেই প্রথম গুলি চালায় পুলিশ। ছাত্র-জনতা তাকে ধরাধরি করে চিকিৎসার জন্য নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। ঘটনার আকস্মিকতায় মিছিলকারীরা হতভম্ব হয়ে যান। এরপর ছত্রভঙ্গ হয়ে যান ছাত্ররা। পুলিশের তাড়া খেয়ে বিমল রায় চৌধুরীসহ কয়েকজন মিছিলকারী পালিয়ে একটি বাড়িতে ঢুকে পড়েন। পরে তারা জানতে পারেন সেটা কোতোয়ালী থানার টিএসআই ফাহমুদ্দিনের বাড়ি। এটা জানতে পেরে তারা সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। পুরো যশোর শহরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সারা শহরে পুলিশ গ্রেফতার অভিযানে নামেন। শুরু হয় ছাত্র ধরা অভিযান। বাস থেকে, দোকান থেকে-এমনকি হোটেলের খাটের তলা থেকেও লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের ধরে এনে নির্যাতন করা হয়েছিল। পুলিশের অত্যাচারে সেদিন দুই শতাধিক ছাত্র আহাত হয়েছিল। এ সময় তারা শিশু এবং নারীদের ওপরও নির্যাতন চালায়। ছাত্রদের খুঁজতে গিয়ে অনেক বাড়ির অভিভাবকদের ওপরও নির্যাতন চালায় পুলিশ। ওই দিন সমগ্র যশোর শহর থেকে পুলিশ প্রায় এক শ ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করেন এবং তাদের উপর নির্যাতন চালান। শহরের চুরিপট্টি এলাকার অনেক বাড়িতে আত্মগোপন করেন নেতৃবৃন্দ। এ সময় এগিয়ে আসে শহরের ঝালাই পট্টির পতিতা পল্লীর মেয়েরাও। তারা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অনেক ছাত্রকে পুলিশের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। যশোরের ঝালাই পট্টির পতিতারা কমপক্ষে ৪০ জন ছাত্রকে তাদের ঘরে লুকিয়ে রেখে বাইরে তালা ঝুলিয়ে পুলিশি নির্যাতনের হাত থেকে তাদের রক্ষা করেন। এমন কী পুলিশের আক্রমণে পালানোর সময় তাড়াহুড়ো ও ধস্তাধস্তিতে মিছিলে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন নারী নেত্রীর শাড়ি খুলে যায়। পতিতারা নিজেদের শাড়ি দিয়ে নারী সৈনিকদের সম্ভ্রম রক্ষা করেন।
‘যশোরের ভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে প্রয়াত কবি ও খ্যাতিমান সাংবাদিক ফখরে আলম লিখেছেন, ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের (এমএম কলেজের পুরাতন হোস্টেল) এলভি মিত্র হলে সভা করে ঢাকার ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর মতো যশোরে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ মার্চ এমএম কলেজে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ৭ মার্চ আবারও সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ-এর কেন্দ্রীয় ছাত্র ধর্মঘটের সমর্থনে যশোরে ৮ ও ৯ মার্চ মিছিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়।
১০ মার্চ জেলা প্রশাসক শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দ কলেজে জরুরি বৈঠক করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও মিছিল মিটিং করার আহ্বান জানান। ১১ মার্চ শহরে মিছিল ও ধর্মঘট পালিত হয়। সেই দিনই পুলিশ ৩৪ জন নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেন। আর ১৩ মার্চের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
যশোরের ভাষা আন্দোলনের গবেষক কবি সাইদ হাফিজ লিখেছেন, তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্বের কারণে কমিউনিস্ট পার্টির উপর সরকার তখনও নির্যাতন চালাচ্ছিল। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ভাষা আন্দোলনের কিছু আগে সম্ভবত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এক সরকারি আদেশ বলে যশোরের তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ইএ নোমানী কমিউনিস্ট পার্টির অফিস, ছাত্র ফেডারেশনের দপ্তর ও অন্য কয়েকটি সংগঠনের কার্যালয় রিকিউজিশান করে নেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমানের বাসায় একটি যৌথ প্রতিবাদ সভা করেন। ভবিষ্যতে সরকারের এ ধরণের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ রুখতে সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘বামপন্থী সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। একই সাথে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। এ ঘটনাকে যশোরের রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষার প্রশ্নে প্রথম সম্মিলিত প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
সভা শেষে শহরে মিছিল বের হয়। ওই মিছিল শেষে পুলিশ বিশেষ ক্ষমতা বলে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে আটকে রাখেন এবং আদালত তাদের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন।
১৯৮৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি যশোর শহরের চুড়িপট্টি এলাকায় ছাত্রনেতা আলমগীর সিদ্দিকীর বাসায় এক জরুরি সভা বসে। সেখানে ঢাকার গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর মতো যশোরে একটি সংগঠন গড়ে তোলার দাবি জানানো হয়। ওই সভায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ১৫ থেকে ২০ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। আলমগীর সিদ্দিকী, সৈয়দ আফজাল হোসেন, সুধীর রায়, হামিদা রহমান, রণজিৎ মিত্র তাদের মধ্যে অন্যতম। ২৮ ফেব্রুয়ারি যশোর সরকারি এমএম কলেজের (পুরাতন কসবায়, এখন পুরাতন হোস্টেল) এলভি মিত্র লেকচার হলে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়,
বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারি নীতির প্রতিবাদে এলভি মিত্র হলের সভায় ২ মার্চ এমএম কলেজে ছাত্র ধর্মঘট ও ওইদিন আরও বৃহত্তর পরিসরে ছাত্রসভা অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো হয়। আন্দোলনকে সফলভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য শতাধিক ছাত্রের উপস্থিতিতে এদিনই ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন আলমগীর সিদ্দিকী ও রঞ্জিত মিত্র। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মনোনীত হন হামিদা রহমান, আফসার আহমদ সিদ্দিকী, সুধীর কুমার রায়, দেবীপদ চট্টোপাধ্যায় (মানিক), সৈয়দ আফজাল হোসেন, অশোক ঘোষ, সুনীল রায়, হায়বাতুল্লা জোয়ার্দ্দার, কাজী আব্দুর রাকীব, আব্দুল হক, শেখ আমানুল্লাহ প্রমুখ। এই কমিটিতে সভাপতির কোনো পদ ছিল না। ছাত্ররা তাদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ও সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টির কাছে ধরণা দেয়। কিন্তু একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী উপদলের নেতা হাবিবুর রহমান ছাড়া আর কারও সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হন। আন্দোলনের ব্যাপ্তির সাথে সাথে সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরে স্থানীয় বেশ ক’জন রাজনৈতিক নেতাকে পরিষদের সদস্য হিসেবে ‘কোঅপ্ট’ করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে প্রসারিত করা হয়। তাদের মধ্যে তৎকালীন যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান কংগ্রেস নেতা ডা. ক্যাপ্টেন জীবন রতন ধর, তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আইনজীবী মশিয়ূর রহমান, মুসলিম লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল খালেক, ফরওয়ার্ড ব্লকের হীরেন সেন, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা অনন্ত মিত্র এবং লুৎফর রহমান প্রমুখ।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ সরকারি নীতির প্রতিবাদে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী যশোরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ভাষা আন্দোলনের প্রথম ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সমর্থনে কলেজে এবং শহরে মিছিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলকারীরা জিলা স্কুল থেকে ছাত্রদের বের করে আনেন। ৭ মার্চ আবারও যশোরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ৮ ও ৯ মার্চ প্রতিদিনই ১১ মার্চের ধর্মঘটের সমর্থনে যশোরে মিছিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ১০ মার্চ যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইএ নোমানী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সকল শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা শুনে ওই দিন বিকেল ৪টায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ নতুন পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ডা. ক্যাপ্টেন জীবন রতন ধর।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সিদ্ধান্ত নেন ১১ মার্চ ১৪৪ ধারা ভেঙে সকাল ১০টায় সরকারি এমএম কলেজ থেকে প্রথম মিছিল বের হবে, সমর্থনকারীরা সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মিছিলে শামিল করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করবেন এবং মিছিল শেষে ট্রেডিং ব্যাংক ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হবে।
বেলা ১১টার দিকে সেখান থেকে বিরাট একটি যৌথ মিছিল বের হয়। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস বর্জনের আহ্বান জানান। এ সময় মিছিলকারীদের কাছে সংবাদ আসে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমান মোমিন গার্লস স্কুল) ও যশোর পিটিআই স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ধর্মঘট ও মিছিলে যোগ দিতে বাধা সৃষ্টি করছে। খবর শুনে পুরো মিছিলটি সেখানে পৌঁছায় এবং সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিলে অংশ গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ওই সময় মোমিন গার্লস স্কুলে পড়তেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইএ নোমানী সাহেবের মেয়ে। মেয়েদের মিছিলে অংশগ্রহণ করতে তিনি প্রচণ্ড বাধা দেন। স্কুল থেকে বের করতে হামিদা রহমান সেদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। হামিদা রহমান তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন এবং সম্ভবত তার একটি দাঁত ভেঙে যায়। এ সময় ভাষাসৈনিক হামিদা রহমান স্কুলে ঢুকে ক্লাস থেকে ছাত্রীদের বের করে আনেন। পিটিআই এর তদানীন্তন প্রধান শিক্ষক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করে মিছিলে যোগ দেন।
এরপর যশোরের সর্বস্তরের মানুষ মিছিলে অংশ নেন। প্রায় এক মাইল দীর্ঘ ওই মিছিলটি তৎকালীন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। পুলিশ বাহিনী মিছিলকে অনুসরণ করে চললো। কিন্তু বিষয় তারা মিছিলে আক্রমণ করলেন না। সুদীর্ঘ মিছিলটি হৃদয়ের সব আবেগ ঢেলে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চললো। পিটিআই সড়ক দিয়ে রেল রোড ও ভোলা ট্যাংক থেকে বামে ঘুরে জেলা স্কুলের দিক থেকে বার লাইব্রেরির সামনে দিয়ে ট্রেডিং ব্যাংকের দিকে এগোতেই জেলা কাউন্সিলের তরুণতম চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মশিয়ূর রহমান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে মিছিলের পুরোভাগে এসে ভিড়লেন। তার সাথে যোগ দেন আরও কয়েকজন আইনজীবী। মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা অ্যাডভোকেট মশিয়ূর রহমানকে করতালি দিয়ে বরণ করে নেন। মিছিল শেষে বেলা ১টার দিকে শহরের ট্রেডিং ব্যাংক মাঠে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মিটিং শেষ হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। বর্তমান পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসের সামনে থেকে মশিয়ূর রহমান, রণজিৎ মিত্র, এসএমএইচ জিন্নাহ, আবদুর রাকীব, অনন্ত মিত্র, পবিত্র ধর, রবি কুমার, হাবিবুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, গোলাম মোর্তজা, লুৎফর রহমান, সৈয়দ আফজাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, ইমান আলীসহ মোট ১৪ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেন। ছাত্র-কর্মীরা গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির দাবিতে কোর্টের সামনে জড়ো হয়ে মিছিল করেন। পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে বন্দিদের দ্রুত জেলখানায় নিয়ে যান। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ওই দিনই পুলিশ আরও ২০ থেকে ৩০ জনকে গ্রেফতার করেন।
এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে রাতে এমএম কলেজর পুরনো হোস্টেল ভবনের ছাদে ছাত্র নেতৃবৃন্দ সংগ্রাম পরিষদের পরবর্তী করণীয় বিষয়ে জরুরি সভা আহ্বান করেন। একমাত্র ডা. ক্যাপ্টেন জীবন রতন ধর ছাড়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের মধ্যে আর কেউ এই সভায় উপস্থিত হননি। সভায় আলমগীর সিদ্দিকী, হামিদা রহমান, আফসার আহমেদ সিদ্দিকী ও সংগ্রাম পরিষদের আরও কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ গোপনে এই বৈঠকের খবর জানতে পারেন এবং সেখানে অভিযান চালিয়ে কলেজ ভবন ঘিরে ফেলেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কলেজের অবাঙ্গালি দারোয়ান কেশব চন্দ্র বুদ্ধিমত্তার সাথে সংগ্রাম পরিষদর সদস্যদের কলেজের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। অবাঙ্গালি হয়েও তিনি বারবার সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতেন। ফলে এ পর্যায়ে তাদের পুলিশের গ্রেফতার এড়ানো সম্ভব হয়।
‘যশোরের ভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে কবি ও সাংবাদিক ফখরে আলম লিখেছেন, ১২ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৩ মার্চ শহরে আবারও মিছিল হয়। ওই মিছিলে প্রায় ৩ হাজার মানুষ অংশ নেন। ১৩ মার্চ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি যশোরের সব শ্রেণি পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সকাল ১০টায় যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এই মিছিলে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরাও যোগ দেন। মিছিলটি শহর প্রদক্ষিণ করে চৌরাস্তা থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় যশোর কালেক্টরেট ভবনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে পুলিশ মিছিলের উপর হামলা চালায়। বেধড়ক লাঠিচার্জ করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে পুলিশের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছোড়ে। ছাত্রদের সহযোগিতার জন্য রিকশাচালক, শ্রমিক, দোকানদাররা এগিয়ে আসেন। তারাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়েন।
একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ডা. জীবন রতন ধর, আলমগীর সিদ্দিকী, আফসার আহম্মেদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কালেক্টরেট ভবনে ঢুকে জানালা, দরজা ভাঙচুর করে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ইএ নোমানীর অফিসেও হামলা চালায়। ছাত্রদের ইটের আঘাতে আহত হন ওসি আব্দুল জব্বার। কোতোয়ালি থানার দারোগা ফামউদ্দিনের মাথা ফেটে যায়। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। পুলিশ ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালানো শুরু করে। গুলিতে সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক আলমগীর সিদ্দিকী আহত হন। তার পায়ে গুলি লাগে। ১৩ মার্চ পুলিশের গুলি চালানোর এই ঘটনাটি ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর প্রথম গুলি বর্ষণের ঘটনা। এই গুলিবর্ষণের ঘটনায় পুরো যশোর শহর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে পুলিশও বেপরোয়া হয়ে নির্যাতন চালানো শুরু করে। এসবের প্রতিবাদে ১৪ মার্চ শহরে আবার হরতাল পালিত হয়। এরপরও লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে।
এইউ