দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, যেখানে প্রতি শীতে ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল প্রায় প্রতিদিনই বন্ধ থাকে। এতে যানবাহন পারাপারে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ সময়ের অচলাবস্থা। শীত মৌসুমের এমন সমস্যা সমাধানে ২০১৫ সালে প্রায় ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা খরচ করে ১০টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট স্থাপন করা হয়। তবে, এই ফগ লাইটগুলো কুয়াশার মধ্যে ফেরি চলাচলের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। অভিযোগ উঠেছে— যেসব লাইট স্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলো ছিল শুধু সার্চলাইট, ফগলাইট ছিল না। ফলে, ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল করতে সক্ষম হয়নি।
ফেরির একাধিক মাস্টার জানান, এই লাইট দিয়ে ভারি বা মাঝারি কুয়াশায় চলাচল করা যায় না। কুয়াশার ঘনত্বের কারণে ফগলাইটের আলোতে কিছুই দেখা যায় না। এছাড়া, স্থাপনের কয়েকদিন পরেই ফেরির লাইটগুলো নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে এই লাইটগুলো এখন কার্যত ব্যবহৃত হচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
২০১৫ সালের জুন মাসে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় টেন্ডারের মাধ্যমে ১০টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়। প্রতি ফগলাইটের মূল্য ছিল ৫০ লাখ টাকা এবং মোট খরচ ছিল ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এই ফগলাইটগুলো নেভিগেশনাল এড হিসেবে দেশের ফেরিতে প্রথম ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল। তবে, বাস্তবে, আগের সার্চলাইটের চেয়েও নতুন ফগলাইটের আলোতে কুয়াশায় নৌ চ্যানেলের মার্কার (বিকনবাতি) দেখা যায়নি।
অথচ অভিযোগ রয়েছে, ফগলাইটগুলোর কেনার প্রক্রিয়া ছিল অস্বচ্ছ। যদিও বলা হয়েছিল, এগুলো আমেরিকার তৈরি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিছু যন্ত্রপাতিতে ‘মেইড ইন কোরিয়া’ লেখা ছিল। প্রথমে মাত্র দুটি ফেরিতে ফগলাইট স্থাপনের পরিকল্পনা থাকলেও বিশেষ মহলের চাপে ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ১০টি ফগলাইট কেনা হয়।
এদিকে, বিআইডব্লিউটিসি’র সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফগলাইট ফেরিতে স্থাপনের পর নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ফেরির রিসিভিং কমিটির সদস্যরা এসব লাইট গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। পরে, কমিটির সদস্যদের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাইটগুলো গ্রহণে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে তদন্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৭ সালে, দুদক তদন্ত করে এবং দেখায়, প্রকল্পের আওতায় বাস্তবে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের পরিবর্তে নিম্নমানের সার্চলাইট সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে, ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিআইডব্লিউটিসি’র তিন কর্মকর্তাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
বিজ্ঞাপন
মামলার আসামিরা হলেন বিআইডব্লিউটিসির সাবেক জিএম ক্যাপ্টেন শওকত সরদার, সাবেক চেয়ারম্যান ড. জ্ঞানরঞ্জন শীল, মহাব্যবস্থাপক নুরুল হুদা, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপ-সচিব পঙ্কজ কুমার পাল, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. রহমতউল্লাহ, মহাব্যবস্থাপক (মেকানিক্যাল) ইঞ্জিনিয়ার নাসির উদ্দিন এবং মেসার্স জনি করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যন্ট কমান্ডার ওমর আলী।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও পিএসআই কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের পরিবর্তে শুধু সার্চলাইটসহ সংশ্লিষ্ট মালপত্র কেনা হয় এবং এর মাধ্যমে ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। এই কাজের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিসি’র কর্মকর্তারা ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়, যেখানে বলা হয়, ফেরিগুলোতে বাস্তবে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের কোনো অস্তিত্বই নেই। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সংযোজিত লাইটগুলো মূলত ৭ হাজার ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সার্চলাইট এবং এগুলোকে ফগলাইট হিসেবে বিকৃত করা হয়েছে।
এছাড়া, ফগলাইট কেনার প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে তারা নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং সরবরাহ কাজে অনিয়ম করেছেন। ২০১৭ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিলেও, বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তদন্তে আরও জানা গেছে, ২০১৪ সালে ৭ হাজার ওয়াটের রিমোট কনট্রোল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৬টি ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট কিনতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি লাইটের মূল্য নির্ধারিত ছিল ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪০০ টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত সাধারণ সার্চলাইট কেনা হয়, যার মূল্য ছিল ১ থেকে ২ লাখ টাকা।
বর্তমানে, পদ্মা সেতু চালুর পর নৌরুটে যানবাহনের চাপ অনেক কমে গেছে, যার কারণে কুয়াশায় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকলেও, ভোগান্তি অনেকটাই কমে গেছে। বিআইডব্লিউটিসি’র ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জানান, শীত মৌসুমে কুয়াশার কারণে ফেরি বন্ধ থাকলেও সংস্থার আয়ে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ, এখন ফেরি সংখ্যা যথেষ্ট, ফলে যাতায়াতকারী যানবাহন শীতের সময় কুয়াশার বিষয়টি মাথায় রেখে চলাচল করে।
প্রতিনিধি/এইউ

