বন্যার তাণ্ডবে ভেসে গেছে ফেনীর পোল্ট্রি ও ডেইরি খামারের স্বপ্ন। ক্ষতির পাহাড়ে চাপা পড়েছে হাজারো উদ্যোক্তার আশা। তাদের চোখে আর কোনো দীপ জ্বলছে না, হৃদয়ে যেন নিঃস্ব শব্দের প্রতিধ্বনি। ৪ মাস পরেও সরকারের সহায়তার আশায় তারা দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ প্রতিটি দিনই যেন তাদের জন্য এক নতুন অন্ধকার। যাদের স্বপ্ন ছিল খামারে সোনালী সকাল, আজ তারা যেন হারিয়ে খুঁজে চলেছেন সেই আলো।
ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের দুর্দশা
বিজ্ঞাপন
ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের মাসুক নামের একজন তরুণ পোল্ট্রি উদ্যোক্তা তার খামারের সব কিছু হারিয়ে এখন কঠিন সংকটের মধ্যে আছেন। গত বছর বন্যায় তার খামারে প্রায় ৫০ হাজার মুরগি ভেসে যায়, এবং তার দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, ‘সবকিছু হারিয়ে জীবনটা অতিষ্ঠ য়ে পড়েছে। ঋণ পরিশোধের চাপ এবং খামারটি পুনরায় চালু করার অনিশ্চয়তা তাকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছে।’
ফেনী জেলাজুড়ে মাসুকের মতো অন্তত ৫ হাজার খামারি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই এখনো সরকারি সহায়তার অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু দীর্ঘ ৪ মাস পার হলেও কোনও সমাধান আসেনি। অনেক খামারি ঋণের চাপ সইতে না পেরে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার কেউ কেউ ছোট পরিসরে উৎপাদন চালু করেছেন, তবে সেই উৎপাদন সীমিত এবং ব্যবসায়িক পরিসর সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির বিশদ পরিসংখ্যান
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের রিপোর্ট অনুযায়ী, বন্যায় ফেনী জেলায় প্রায় ৫ হাজার খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ২২টি গবাদি পশুর খামারে ৫৫ হাজারের বেশি গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া মারা গেছে, যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১৬৭ কোটি টাকা। এছাড়া ২ হাজার পোল্ট্রি খামারে প্রায় ২৩ লাখ মুরগি মারা গেছে, এতে ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সরকারের ভূমিকা এবং ক্ষোভ
বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সহায়তার জন্য জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল, যেমন- খামারীদের মধ্যে খাবার ও পশুদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান। কিন্তু এ সকল সহায়তার পরেও অনেক খামারী এখনও পূর্ণোদ্যমে খামার চালু করতে পারেননি। ফেনী জেলা পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল আলম জানান, ‘এত বড় ক্ষতির পরেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর সহায়তা পাওয়া যায়নি, যা বেকায়দায় ফেলেছে খামারীদের।’
জেলা প্রশাসনের অবস্থান
ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, ‘ফেনীতে পোল্ট্রি ও ডেইরী খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সরকার এ খাতের পুনরুদ্ধারের জন্য উদ্যোগ নিতে পারে।’ তবে তিনি জানান, বিষয়টি এখন ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আলোচনায় রয়েছে এবং শিগগিরই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
সমাধানের প্রয়োজনীয়তা
খামারিদের মতে, সরকারি সহায়তা ছাড়া পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ খাতের সাথে জড়িত হাজার হাজার খামারি এখনও শূন্য হাতে অপেক্ষা করছেন এবং ফেনীতে ডিম, মাংস ও দুধের সংকট প্রকট হচ্ছে। এজন্য পোল্ট্রি ও ডেইরি খামারিদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে।
বন্যার ক্ষতিপূরণ, প্রণোদনা এবং ঋণ সহায়তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পূণর্বাসন কার্যক্রম শুরু না হলে ফেনী জেলার পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপে এই খাতের উদ্যোক্তাদের পুনরায় কাজে ফিরে আসা সম্ভব, যা খাদ্য উৎপাদন চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।
প্রতিনিধি/একেবি

