চাঁপাইনবাবগঞ্জে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামক অনিবন্ধিত এনজিওর মালিক মাসুদ রানা ও তার পরিবার গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় ১০৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ৩৫ হাজার গ্রাহক এখন শঙ্কিত, কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের জমানো টাকা ফেরত পেতে আদালতে মামলা দায়ের করলেও কোনো সুরাহা পায়নি। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এসব মামলার কার্যক্রম থমকে রয়েছে এবং নানান ষড়যন্ত্রের ফলে টাকা ফেরত পেতে আরও বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। বর্তমানে, গ্রাহকরা সরকার, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের কাছে তাদের টাকা ফেরতের দাবি জানিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ৪৬টি শাখায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের ১০৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধ অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে আটক হন মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা। এরপর একে একে টাকা ফেরতের দাবিতে মামলা করেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। পরে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মালিক মাসুদ রানা এবং প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা মাসুদ রানার পরিবারের ১৮ জন সদস্য কারাগারে থাকলেও টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকরা।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ উঠেছে, সরকারের পতনের পর মাসুদ রানা ও তার পরিবার আত্মসাতকৃত ১০৫ কোটি টাকা ফেরত না দিতে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে যোগাযোগ রেখে টালবাহানা শুরু করে। এমনকি যেকোন মূল্যে ৩৭২টি মামলায় জামিন নিয়ে বাইরে আসার পরিকল্পনা করছে তারা। অনুসন্ধানে জানা যায়, টাকা ফেরত না দিতে নানারকম ষড়যন্ত্রের খবরে আরও ১ হাজার মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা।
আরও পড়ুন—
জানা যায়, শনিবার (৪ জানুয়ারি) দুই পক্ষের আইনজীবী ও মাসুদ রানার প্রতিনিধিরা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে ৫০টি মামলার বাদী ও গ্রাহকের সাক্ষাৎকার ও তথ্য সংগ্রহ করেন। এনিয়ে প্রত্যেক শনিবার মামলার বাদিদের সাক্ষাৎকার ও তথ্য গ্রহণ করে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা জানা যায়। তবে মামলার বাদি ও অন্যান্য গ্রাহকদের অভিযোগ, ৩৭২টি মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করতেই এমন নাটক করা হচ্ছে এবং ষড়যন্ত্রের একটি নতুন কৌশল এটি।
বিজ্ঞাপন
শনিবার (০৪ জানুয়ারি) দুপুরে আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার পর মামলার বাদি টুম্পা ভট্টাচার্য জানান, ‘আমি অনেক কষ্টে জমানো টাকা জমা দিয়েছিলাম মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায়। কিন্তু মালিক মাসুদ রানা আটকের পর তা নিয়ে নাচোল আমলী আদালতে মামলা দায়ের করলেও কোন সুরাহা হয়নি। এখন সাক্ষাৎকারে এসে তার আইনজীবী বলছে কিছু টাকা নিয়ে জামিন দিলে হয় না? কিন্তু এতো হয়রানির পর কেন কম টাকা নিব? এসব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে গ্রাহকের টাকা নিয়ে।’
সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের গ্রাহক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘জামানতের টাকা হারিয়ে আমরা এখন পথে বসেছি ৩৫ হাজার গ্রাহক। অথচ আমাদের শতকোটি টাকা নিয়ে জেলে বসে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে মাসুদ রানা ও তার পরিবারের সদস্যরা। মাসুদ রানা ও তার পরিবারের ১৮ জন সদস্য গ্রাহকের এসব টাকা নিয়ে আত্মসাত করার অপরাধে কারাগারে আছে। আমরা গত ২ বছর ধরে ৩৫ হাজার গ্রাহক ঐক্যবদ্ধ রয়েছি। আদালতের নিকট আবেদন, যেভাবেই হোক আমাদের এই টাকা ফেরত দেয়া হোক।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক জানান, ‘৩৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ৩৭২টি। অথচ আইনজীবীরা এখন শুধুমাত্র মামলার বাদিদের সাথে বসছে এবং তাদেরকে টাকা ফেরতের কথা বলে সাক্ষাৎকার নিচ্ছে ও প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তাহলে বাকি গ্রাহকরা আমরা কি করব? প্রয়োজনে আমরা ৩৫ হাজার গ্রাহকরা মামলা করব। এসব ষড়যন্ত্র করে টাকা ফেরত দিতে নানারকম টালবাহানা করছে মাসুদ রানার লোকজন।’
মধুমতি গ্রাহক ফোরামের সভাপতি শ্রী রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘আমরা ৩৫ হাজার গ্রাহক মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মালিক মাসুদ রানার সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছি এবং সেসময় মাসুদ রানা ৫০ কোটি টাকা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এখন নতুন করে আবার ষড়যন্ত্র ও টালবাহানা শুরু হয়েছে। আমরা গত ২ বছর ধরে মানববন্ধন, সমাবেশসহ বিভিন্ন আন্দোলন করেছি। প্রয়োজনে আবারো কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি বাকি গ্রাহকরা মামলা করবে।’
মধুমতি গ্রাহক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম মাওলা জানান, ‘মাসুদ গং টাকা ফেরত না দিতে নানারকম টালবাহানা করছে। আমরা গ্রাহকদের শতকোটি টাকা ফেরত নিয়ে শঙ্কায় দিনযাপন করছি। স্থানীয় প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকলের কাছে আবেদন, টাকা ফেরত ছাড়া যাতে কোন সিদ্ধান্ত না নেয়া হয়। কারণ মাসুদ রানার লোকজন আমাদের পাশবইসহ সকল ডকুমেন্ট নিয়ে নিলে পরবর্তীতে আমাদেরকে ফেরত না দেয়াসহ নানারকম বিপদে ফেলতে পারে, এই আশঙ্কায় আছি।’
সদর উপজেলার কালিনগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নাইমুল হক বলেন, ‘মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা জেলাজুড়ে ৪৬টি শাখায় অবৈধ ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সাধারণ জনগণকে এক লাখ টাকা জমা রাখলে মাসে ১২০০ টাকা লাভ দেয়া হবে এবং জমাকৃত টাকা চাওয়া মাত্র ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে মধুমতি। এভাবে জেলার পাঁচ উপজেলায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১০৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। আজকাল করে টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে সময় পার করে এবং টাকা না দিতে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা স্বেচ্ছায় অস্ত্রসহ আটকের নাটক করে।’
সদর উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের সূর্যনারায়নপুর গ্রামের স্নাতক পড়ুয়া লতিফা খাতুন বলেন, ‘আমার কোন ভাই নেই। বাবার উপার্জনের ৬ লাখ টাকা মধুমতি এনজিও-তে জমা রেখেছিলাম। কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পরেও এখন চিকিৎসা করার জন্য টাকা উত্তোলন করতে পারছি না। বারবার এনজিও অফিসে ঘুরেও দিব, দিচ্ছি বলে না দেয়ার পায়তারা করছে। টাকার জন্য এখন অসহায় দিনযাপন করছি।’
জেলা শহরের বিজয় নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সানজিদা খাতুন জানান, ‘জমি বিক্রি করে টাকা জমা রেখেছিলাম মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায়। সেখান থেকে মাসে মাসে টাকা তুলে বেতন দিতাম। কিন্তু কয়েকমাস থেকে টাকা আত্মসাত করে পালিয়েছে এর মালিক পক্ষের লোকজন। এখন কলেজের বেতন দিতে পারছি না। জনগণের টাকা নিয়ে যে সমস্ত সম্পদ তৈরি করেছে, তা বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।’
প্রতিনিধি/একেবি