বহুল আলোচিত ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে ১৮ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আত্মসমর্পণ ছিল আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম। ওই দিন ববি শিক্ষার্থীদের কাছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরাজয়ের খবর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীরা উজ্জীবিত হন।
এছাড়াও, বছরের শুরুতে বিএনপির ভোট বর্জন করে লিফলেট বিতরণ নগরীতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, ছাত্রজনতার উল্লাস, অগ্নিসংযোগের ঘটনা বরিশালবাসীর স্মৃতিতে থাকবে বহু বছর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিএনপির মামলায় আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের গ্রেফতারসহ বেশ কিছু ঘটনা ছিল আলোচনায়।
বিজ্ঞাপন
কোটা সংস্কার আন্দোলনের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সমন্বয়ক সুজয় শুভ বলেন, “১৮ জুলাই আমাদের পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি ছিল। কর্মসূচি সফল করতে আমরা যাতে মহাসড়কে না নামতে পারি, সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাম্পাস ঘিরে রাখে। এরপর আমরা যারা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছিলাম, তারা কীর্তনখোলা নদী পার হয়ে ভিন্ন পথে বিভিন্ন কৌশলে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। পরে আমরা মহাসড়কে উঠার চেষ্টা করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাঁধা দেয়। আমরা বাঁধা উপেক্ষা করতে চাইলে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, ছড়ড়া গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এতে কমপক্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। আহতদের মধ্যে অন্তত ৮০ জন শিক্ষার্থী ছড়ড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়। ওই দিন বেল্লাল হোসেন নামে এক স্থানীয় অটোরিক্সা চালক ছড়ড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়। এতে ওই অটোরিক্সা চালক চোখ হারান। তখন শিক্ষার্থীরা জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়রা দল বেধে যোগ দেয়। পরে শিক্ষার্থী ও জনতা মিলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবরুদ্ধ করে। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হাত উঁচিয়ে ব্যারাকে ফিরে যায়।”
এই খবর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনে গতি বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বিএনপি ভোট বর্জন করে। এরপর বিএনপি নেতাকর্মীরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে লিফলেট বিতরণ করে। বিএনপির এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বরিশালে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিএনপির সাত নেতা গ্রেফতার হন। ১০ মে অনুষ্ঠিত বই বিনিময় উৎসব বরিশালে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এই উৎসবে বরিশাল নগরীর জ্ঞানপিপাসুরা বই বিনিময় করে, যা সামাজিক মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হয়।
বিজ্ঞাপন
১২ জুন বরিশাল নগরীর কাউনিয়ায় একটি ফ্ল্যাট থেকে বাবা ও মেয়ের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চাকরি হারিয়ে অর্থ সংকটে থাকা বাবা তার সন্তানকে হত্যা করে এবং পরে আত্মহত্যা করেছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানিয়েছিল। এরপর ২৯ জুন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য ক্রীড়াবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম সুরুজের মৃত্যু হয়। এতে বরিশাল নগরীতে কয়েক দিন শোকের আবহ বিরাজ করে।
সরকার পতনের আগের দিন ০৪ আগস্ট নগরীর হাতেম আলী কলেজের চৌমাথায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তখন প্রকাশ্যে গুলি চালানোর সময় ছাত্রজনতা নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি টুটুল চৌধুরী (৬০)কে আটক করে গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। একই দিন বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে গিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ০৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর বিজয় উল্লাসে বরিশালবাসী। বিজয় উল্লাসের মধ্যেই বিক্ষুব্ধ জনতার একটি দল নগরীর সাবেক সংসদ সদস্যের বাড়ি, কালীবাড়ি রোডের সেরনিয়াবাত ভবন, বিসিসির অ্যানেক্স ভবন ভাংচুর করে। এছাড়াও, বিভাগজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়।
সরকার পতনের দিন বরিশাল নগরীর কালীবাড়ি রোডে সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতার একটি দল। এতে আগুনে পুড়ে মারা যান সাবেক কাউন্সিলর গাজী নঈমুল হোসেন লিটুসহ তিনজন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলমান থাকার মধ্যেই নগরীর সিঅ্যান্ডবি রোডে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আহত হন।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর হামলার ঘটনায় ২২ আগস্ট প্রথম রাজনৈতিক মামলা দায়ের হয়। এই মামলা দায়ের করেন বরিশাল নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক। সেই মামলায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম, সাবেক মেয়র আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত ও সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন, এফবিসিআইয়ের পরিচালক মঈনুদ্দিন আবদুল্লাহসহ এক হাজার ৮১ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
তবে বরিশালবাসীকে ভিন্নভাবে গর্বিত করেছে ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান নিপা। তিনি গিনেসবুকে দ্বিতীয়বার রেকর্ড করলে তা বরিশালবাসীকে আনন্দিত করে। এছাড়া ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত মাহাথির রহমান এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করায় বরিশাল বিভাগজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি হয়। এছাড়া বছরজুড়ে আলোচনার মধ্যে ছিল বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের ঘোষণা।
প্রতিনিধি/একেবি

