সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

শুধু রং তুলির আঁচড়ে চলে ৩০০ বছরের পুরোনো নাটোর রাজবাড়ির সংস্কার কাজ

মো. লিটন হোসেন লিমন, নাটোর
প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

রং তুলি দিয়ে চলে ৩০০ বছরের পুরানো নাটোর রাজবাড়ির সংস্কার কাজ

নাটোরের নাম নিলে স্মৃতিতে চলে আসে রাজা-রানীদের শাসন আমলের এক বিশাল ইতিহাস। সেই ৩০০ বছর আগে নির্মিত অর্ধবঙ্গেশ্বরী খ্যাত রানী ভবানীর রাজবাড়ি। রাজা রামজীবন প্রায় ৫০ একর জমির ওপরে এ রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। এরপর অনেক রাজা এ রাজবংশ শাসন করেছেন। এখন রাজা-রানী না থাকলেও রয়েছে, তাদের স্মৃতি বিজড়িত রাজবাড়িটি। যুগ যুগ ধরে অযত্নে হারিয়ে যেতে বসেছে তার স্থাপত্যশৈলী ও সৌন্দর্য। রাজবাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর দায়িত্ব নিলেও তেমন কোনো বড় সংস্কারের মুখ দেখেনি এই নিদর্শনটি। ফলে সংস্কারের অভাবে দিনে দিনে নষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন ভবনের অবকাঠামো ও স্থাপত্যশিল্প।

thumbnail_IMG_20241228_133523


বিজ্ঞাপন


২০১৮ সালে বড় তরফটি সংস্কার হিসেবে রং করা হয়। তবে ছোট তরফের কিছু ভাঙা কাঠের দরজা-জানালা মেরামতের কাজ করা হলেও এখনেও রঙের হাত পড়েনি। তবে বড় তরফের দক্ষিণে বৈঠক খানাটি রং করে কিছুটা সৌন্দর্য বাড়ানো হয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর রাজবাড়ির দেয়ালে শুধু রং ও ফাটল বন্ধ করা ছাড়া তেমন কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি।

পর্যটকরা বলছেন, প্রাচীন এ নিদর্শনগুলোর অবকাঠামো সংস্কার করা না হলে এক সময় ইতিহাস থেকে মুছে যাবে। সেজন্য সরকারকে এখনই সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। সংস্কার হলে দেশ-বিদেশ থেকে যেমন পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে, তেমন ইতিহাস আরও সমৃদ্ধি হবে।

thumbnail_IMG_20241228_133921

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রাচীন এ স্থাপত্যশৈলীর অনেক অংশ প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে নষ্ট হয়েছে। হারিয়েছে তার সৌন্দর্য। বিভিন্ন ভবনের গায়ে নিখুঁত নির্মাণ কৌশল দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। তখনকার শিল্পীদের নিখুঁত হাতে প্রসাদের গায়ে আঁকা চমৎকার শিল্পকর্ম আজ জানান দিচ্ছে তাদের কর্মদক্ষতা। দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি প্রকাশ পাচ্ছে। কিছু ভবনের ওপর থেকে ইট মাটি খসে খসে পড়ছে। অনেক ভবনে ময়লা-আর্বজনা স্তূপে পরিণত হয়েছে। ভেতরে যেন মানুষের মলমূত্রের ভাগাড় জমেছে। অপরদিকে পুকুরের পাড়ে শতবর্ষী অনেক গাছ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।


বিজ্ঞাপন


thumbnail_IMG_20241228_134121

জানা যায়, ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামজীবন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। ১৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পর তার দত্তকপুত্র রামকান্ত রাজা হন। ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রামকান্তের মৃত্যুর পর রানী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৮০২ সালে রানী ভবানীর মৃত্যুর পর তার দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণের দুই পুত্র বিশ্বনাথ ও শিবনাথের মধ্যে জমিদারি ভাগাভাগি হয়। বড় ছেলে বিশ্বনাথ পান বড় তরফ এবং ছোট ছেলে শিবনাথের পেয়ে যান ছোট তরফ। সেই থেকে তাদের উত্তরাধিকারীরা ছোট তরফ ও বড় তরফ নামে জমিদারি পরিচালনা করেন।

thumbnail_IMG_20241228_134149

বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন নাটোর রাজবংশের ছোট তরফের শেষ রাজা। তিনি ১৮৯৭-১৯৫৫ খ্রি. পর্যন্ত রাজত্ব করেন। বড় তরফের রাজা যোগীন্দ্রনাথ ১৮৮৬-১৯৮১খ্রি. পর্যন্ত দেশভাগের সময় তারা ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল করেন। এই রাজবাড়ি চত্বরে ছোট বড় ৮টি ভবন, ছোট বড় মিলে ৫টি পুকুর রয়েছে। শিব মন্দিরসহ বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। রাজবাড়ির নিরাপত্তার জন্য চারিদিকে ঘিরে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। যা আজও সেই অবস্থায় আছে। অন্যদিকে এক ভূমিকম্পে রানী মহলের বেশিরভাগই মাটির নিচে দেবে গেছে।

রাজশাহী থেকে আসা দর্শনার্থী শাহাবুদ্দিন বিপ্লব বলেন, নাটোর রাজবাড়ির ইতিহাস সবার জানা। আজ পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছি, অনেক ভালো লেগেছে। তবে পুরো রাজবাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করা হলে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে দর্শনার্থীর সংখ্যাও বাড়বে।

thumbnail_IMG_20241228_134213

ঘুরতে আসা রাজশাহীর বাসিন্দা আফরোজা আক্তার বলেন, জায়গাহটি অনেক নিরিবিলি। তবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি থাকলে আরও ভালো লাগতো। বিশেষ করে প্রাসাদগুলো অনেক পুরানো প্রাচীন। সেগুলোকে যত্ন নিয়ে সংস্কার করলে আরও সুন্দর লাগতো।

খুলনা থেকে আসা দর্শনার্থী শামীম হোসেন বলেন, পুরো রাজবাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম ভালো লাগলো। তবে আধুনিকায়ন করলে সৌন্দর্য ফিরে পেত। এছাড়া পুরানো সব নির্দেশনগুলো থাকা দরকার ছিল। পুরো রাজবাড়িটি নতুনভাবে সংস্কার করা হলে ইতিহাস সমৃদ্ধি হতো।

thumbnail_IMG_20241228_134607

নানা-নানির সঙ্গে আসা শিশু লাবনী খাতুন বলে, নানা, নানু ও খালামনির সঙ্গে ঘুরতে এসেছি। এখানে বড় বড় প্রসাদ, পুকুর দেখে ভালো লেগেছে।

স্কুল শিক্ষক মাহবুবর রহমান বলেন, রানী ভবানী হিসেবে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়িটির অনেক ইতিহাস রয়েছে। এ রাজবাড়ির অনেক ইতিহাস পড়েছি, আজ দেখতে এসেছি। এখানে যদি নতুন করে সংস্কারের মাধ্যমে ফুলগাছ, লতাপাতা দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো যেত। তাহলে বড় একটি পর্যটন স্থান পেত। এসব নিদর্শন মানুষের স্মৃতি সমৃদ্ধ করে।

thumbnail_IMG_20241228_133510

নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আরিফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, নাটোর রানী ভবানীর রাজবাড়িটি দেশব্যাপী অনেক সুনাম রয়েছে। আমাদের একটি বড় পর্যটন স্থান এটি। এখানে প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক আসেন। একবারে তো এত বড় রাজবাড়ি সংস্কার করা সম্ভব নয়। আমরা ধাপে ধাপে ভবনগুলোর সংস্কার কাজ করছি।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর