‘আমার জীবনটা অনেক কষ্টের। ছোট থেকেই বাবা-মায়ের আদর পাইনি। আমি যখন ছোট, আমার আব্বা আম্মাকে ছেড়ে দিয়েছে। আব্বা অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে। আবার আম্মাও অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে। আমার আইডি কার্ডে যার নাম আছে সেও আমার সৎ বাপ।’ কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ছোট বাচ্চাদের গ্যাস বেলুন বিক্রেতা টুলি বেগম (৪৫)।
শুক্রবার (৩ জুন) দুপুরে রাজশাহী নগরীতে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা হয় তার। টুলি জানান, দুই ছেলে, দুই মেয়ে ও স্বামী নিয়ে চলছিল তার সংসার জীবন। এক সময় অন্যের বাসা-বাড়িতে কাজ করে কিংবা হোটেল পানি দেওয়ার কাজ করেই সংসার চালানোয় সহযোগিতা করতেন তিনি। স্বামী-স্ত্রীর সামান্য উপার্জনের সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই স্বামীর মত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন প্রবাসে পাড়ি জমানোর। একটু ভালো থাকতে এবং মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই খুঁজতেই এমন ভাবনা গৃহহীণ পরিবারটির। অতীতের কষ্ট নিবারণের আশায় চলে যান সৌদি আরব।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু প্রতারকের খপ্পরে পড়ে প্রবাস জীবনেও কষ্ট নেমে আসে টুলি বেগমের কপালে। সেই দুর্বিষহ জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রচুর কাজ করিয়ে নিত। খুবই অত্যাচার করতো। যেখানে একটা থালা বাসন মাজতে হতো সেখানে ৫টা নোংরা করে। বিভিন্ন বাহানা করে আমাকে মারত। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ি। সিদ্ধান্ত নিই এভাবে থাকতে পারবো না।’
তিনি জানান, এক পর্যায়ে তাদের সাথে গণ্ডগোল হয়। ওই বাসা থেকে পালিয়ে যান টুলি। থানার কার্যক্রম শেষে এক দেড় মাসের মতো জেলখানায় থাকতে হয়। পরে ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
বিদেশ থেকে ফিরে তার জীবনে নেমে আসে আরেক কালো অধ্যায়। প্রবাস জীবনে পাঠানো সকল টাকা খরচ করেও অস্বীকার করতে থাকেন স্বামী। বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনার কথা বললেও দেশে ফিরে দেখেন সবই ছিল মিথ্যার ফুলঝুরি। কিছুদিন পর তাকে ছেড়ে যায় স্বামী। বিয়ের রেজিস্ট্রেশন কাগজ না থাকায় ভাত-কাপড় দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেন। একই বাসায় থাকা বড় ছেলেও খোঁজ নেয় না মায়ের।
এমন দুঃসময়ে আশীর্বাদ হয়ে আসেন এক দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই। তার পরামর্শে অন্য এক লোকের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন টুলি বেগম। বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিল, মাজারের ওরশ বা মেলায় বিক্রি করতেন ছোট বাচ্চাদের খেলনা।
বিজ্ঞাপন
এক পর্যায়ে একাই ব্যবসা শুরু করেন টুলি বেগম। ৬৬০ টাকার বিভিন্ন খেলনা দিয়েই শুরু হয় ব্যবসা জীবন। এক পর্যায়ে রাজশাহী নগরীর এক খেলনা বেলুন বিক্রেতার সাথে পরিচয় হয় তার। তার কথা মতো শুরু করেন খেলনা গ্যাস বেলুন বিক্রি। প্রতিদিনের বিক্রি শেষে আসল টাকা দিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়েই চালান সংসার।
বর্তমানে দুই মেয়ে ও এক নাতি নিয়েই টুলি বেগমের সংসার। আলাদা বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন স্বামী। বড় মেয়ের স্বামী চাকরিসূত্রে ঢাকায় থাকলেও খোঁজ নেয় না স্ত্রী-সন্তানের। আর ছোট মেয়ের জামাই নেশাগ্রস্ত হওয়ায় তাকেও আশ্রয় নিতে হয়েছে মায়ের কাছে।
তিনি বলেন, ‘এক আল্লাহ ছাড়া আমাকে দেওয়ার মতো কেউ নেই। আমার কোনো ঘর বাড়ি নেই। সরকারের পক্ষ থেকে যদি একটা বাড়ির ব্যবস্থা বা সহায়তা করত, তাহলে আমি ব্যবসা করে খেতে পারতাম।’
প্রতিনিধি/এএ

