জামদানী শাড়ির নাম শুনলেই প্রথমে নারায়ণগঞ্জের নাম মনে আসে। জেলার সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজারে তাঁতীদের নিপুণ হাতে তৈরি জামদানি শাড়ির সুনাম দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এই শাড়ি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও রপ্তানি হয়।
জামদানি আমাদের গর্ব, আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। একসময় ধনী পরিবারের নারীরাই জামদানি শাড়ি পরতেন, তবে এখন এর চাহিদা মধ্যবিত্তসহ সাধারণ শ্রেণিতেও রয়েছে। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ইউনেস্কো জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগলিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বিজ্ঞাপন
তবে, দক্ষ জনবল, পুঁজির অভাব এবং ভারতীয় শাড়ির বাজারজাতের কারণে গত কয়েক বছরে জামদানির কদর কমেছে। ফলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগর ও তাঁতিরা এখন ভালো নেই। তাঁরা কোনো রকমে জামদানি শিল্প টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
২০২১ সাল পর্যন্ত করোনা মহামারি ও অন্যান্য দুর্যোগের কারণে জামদানি বিক্রি কমে গিয়েছিল। তবে ২০২২ সালে পরিবর্তন দেখা যায়। সে বছর ঢাকাসহ সারাদেশের পাইকারদের আগমনে জামদানি বিক্রি কিছুটা বাড়ে। কিন্তু ২০২৩ সালে তা আবার থমকে যায়। দক্ষ জনবল এবং পুঁজির অভাবে অনেক তাঁতখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
ভারতীয় শাড়ির বাজারজাতের ফলে জামদানি বাজার ওঠা-নামা করছে। একদিকে দাম কমে গেছে, অন্যদিকে এই পেশায় নতুন কেউ আসছে না, ফলে জামদানি তৈরির কারিগর এবং বিক্রয় কেন্দ্রও কমে গেছে সোনারগাঁয়ের অনেক গ্রামে।
উপজেলার তাতপল্লী গুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আগের তুলনায় কর্মচাঞ্চল্যতা নেই। চৌরাপাড়া, মুছারচর, বাইশটেকি, আলমদীচরভুলা, মালিপাড়া, সাদিপুর, ব্রাহ্মণবাওগাঁ, খেজুরতলা, কাজিপাড়া, শেকেরহাট, বাসাবো, তিলাব, বস্তল, কলতাপাড়া, কাহেনা, গণকবাড়ি, ওটমা, রাউৎগাঁও, নয়াপুর, উত্তর কাজিপাড়া, চেঙ্গাইন, খালপাড় চেঙ্গাইন, ভারগাঁও, কান্দাপাড়া, ফিরিপাড়া, আদমপুরসহ প্রায় ৩১টি গ্রামের জামদানি তাতগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞাপন
সাদিপুর ইউনিয়নের বাইশটেক গ্রামের জামদানি কারিগর শামীম মিয়া বলেন, ‘কাজ নেই, লোকজন কাজে আসতে চায় না, ভারতীয় শাড়ি নকল জামদানি বেশি ছড়িয়ে পড়েছে, তাই ন্যায্য দামে বিক্রি হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘২৫ বছর ধরে এই পেশায় আছি, আমরা যারা শাড়ি তৈরি করি, কেউই সঠিক মজুরি পাই না। তবে আমাদের কাছ থেকে যারা কিনে বিক্রি করছেন, তারা ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। ১২শ টাকার একটি শাড়ি তৈরি করতে আমাদের এক সপ্তাহ লেগে যায়। এই দামের শাড়ি প্রতিমাসে সর্বোচ্চ চারটি তৈরি করা সম্ভব হয়। আর ২০ হাজার টাকার শাড়ি তৈরি করতে তিন সপ্তাহ লাগে। বর্তমানে সঠিক মজুরি না পাওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে ছোটবেলা থেকে আমি এই কাজ করে আসছি। বর্তমানে যারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত, তারা সবাই দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করে আসছেন। তাদের অন্য কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। এই শিল্পের খারাপ সময় যাওয়া সত্ত্বেও অনেকেই মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এই পেশা ছাড়তে পাচ্ছেন না।’

জামদানি হাউজের কারিগর আব্দুল বারেক বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে এই কাজ করছি। মামা-খালাদের দেখে এই পেশায় এসেছি। বর্তমানে এখানে ১০ জন কারিগর আছেন, যারা সবাই দীর্ঘদিন ধরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে আমাদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো, তা দিয়ে সংসার চলত, কিন্তু এখন তা দিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেশিরভাগ কারিগররা আগের প্রজন্ম থেকে এই কাজ শিখলেও, এখনকার প্রজন্মের কেউই এই কাজ শিখতে আগ্রহী নয়।’
মালিপাড়া এলাকার একটি জামদানি কারখানার মালিক শুক্কুর আলী বলেন, ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এমন এক সময় আসবে, যখন এই শাড়ির অনেক দাম থাকবে, কিন্তু শাড়ি তৈরি করার জন্য তাঁতি পাওয়া যাবে না। তখন হয়তো জামদানি শাড়ি তৈরির যন্ত্রপাতিগুলো জাদুঘরে পড়ে থাকবে। কেউ এখন এটাকে পেশা হিসেবে নিতে চান না।’
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের জামদানি পল্লীর তুষার জামদানি হাউজের মালিক মো: তামীম আহমেদ দ্বীপ্ত জানান, ‘১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত জামদানি শাড়ি পাওয়া যায়। বর্তমানে অনলাইনের কারণে আমাদের এখানে ক্রেতাদের চাহিদা অনেক কমে গেছে। আজ থেকে ৫ বছর আগে জামদানির চাহিদা অনেক ভালো ছিল, এখন তাঁতশিল্প জামদানি শাড়ি প্রায় বিলুপ্তির পথে।’
সোনারগাঁ জামদানি তাঁতি সমিতির সভাপতি মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘দক্ষ কারিগরের অভাবে জামদানি শিল্প এখন হুমকির মুখে। বর্তমানে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তবে, এখনো জামদানি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।’
তিনি আরও বলেন, ‘দক্ষ কারিগর, পুঁজি ও পাইকারদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারলে জামদানি শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। তবে বিগত সময়ের তুলনায় জামদানির চাহিদা কমে গেছে কয়েক গুণ। এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।’
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের জামদানি পল্লী দেখভালকারী উপ-পরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার জানান, ‘সোনারগাঁয়ের বিখ্যাত জামদানি শিল্প এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। জামদানি শিল্পের মূল সমস্যা হচ্ছে কারিগর সংকট।’
তিনি বলেন, ‘এই পেশায় সারাদিন কাজ করে সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পাওয়া যায়, আর অন্য পেশায় কাজ করলে আরও বেশি টাকা পাওয়া যায়। জামদানি শিল্প বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ এটি। মহাজনরা এই ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু কারিগররা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে ও আগামী প্রজন্মকে এই পেশায় উৎসাহিত করার জন্য আমরা সোনারগাঁয়ে একটি বিপণন কেন্দ্র চালু করেছি। এছাড়া এখানে একটি কারুপল্লী রয়েছে, যেখানে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সোনারগাঁয়ের বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে জামদানি শিল্পটা টিকে আছে। আমরা এই শিল্পটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি।"
প্রতিনিধি/একেবি

