গত কয়েক বছর থেকে আলুর ভালো দাম পেয়ে এবারও আলু চাষ করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন জয়পুরহাটের কৃষকরা। মৌসুমের শুরুতেই বীজ ও সারের দাম বেশি হলেও, নিয়তি মনে করেই তারা আলু চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। দিন-রাত সমান করে কলের লাঙল দিয়ে জমি চাষের পর বিঘার পর বিঘা জমিতে আলু রোপণ করছেন কৃষকরা। পুরো মাঠজুড়ে কৃষকদের কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে, যা থেকে ৯ লাখ ৮ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের আশা করছেন তারা। গত বছরও জেলায় রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছিল। তারপরও সারাবছর বেশি দামেই আলু বিক্রি হয়েছে। গত প্রায় তিন বছর ধরে আলু চাষে লাভবান হয়েছেন কৃষকরা। এবার আলুর দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। ফলে মৌসুম শুরুর পর থেকেই কৃষকরা আলু চাষের প্রস্তুতি শুরু করে।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবছর জেলায় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম জাতের আলু চাষ করে কৃষকরা লাভবান হতেন, কিন্তু এবার সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে অসময়ের বৃষ্টির কারণে। গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে কয়েক দফা বৃষ্টির কারণে আগাম আলু চাষ করতে পারেননি কৃষকরা। তবে এখন আবহাওয়া ভালো থাকায় জেলার বিভিন্ন মাঠে আলু চাষের ধুম পড়েছে। বীজ, সার ও শ্রমের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার আলু চাষে অনেক খরচ বেড়েছে। কৃষকরা জানায়, উন্নত জাতের আলু বীজের চাহিদা বেশি থাকায় ৪০ কেজির এক বস্তা আলু বীজ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে, অথচ কম্পানি নির্ধারিত ওই বীজের দাম সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২০০ টাকা। আবার সারের দামও বেড়েছে। বস্তা প্রতি তিন থেকে চারশ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে এবার এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে তাদের খরচ পড়ছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। জমির দাম ধরলে সাথে আরো ১০ হাজার টাকা যোগ হবে।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার বানিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই কৃষি কাজ করছি। আগে দিনমজুর সংকট ছিল না, এখন টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না। এক বিঘা জমিতে এবার আলু চাষ করতে অনেক খরচ পড়ছে। আলুর শুধু রোপণ খরচই আড়াই হাজার টাকা। মাস খানেক পর আলু বাঁধাই করতে আবার খরচ হবে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার। এছাড়া শুরুতে বীজ ও সারের মোটা খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার নিচে কোনো কৃষক আলু ঘরে তুলতে পারবেন না।’
ওই গ্রামের কৃষক আবু রাশেদ বলেন, ‘বত্রিশশ টাকার চল্লিশ কেজির এক বস্তা উচ্চ ফলনশীল আলু বীজ কিনতে হয়েছে ছত্রিশশ চল্লিশ টাকায়। আবার সারেও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অন্তত তিন থেকে চারশ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে। জমির পত্তনি (লীজ) দামও বেড়েছে। এবার তিনি সাড়ে চার বিঘা জমিতে অ্যাস্টেরিক জাতের আলু রোপণ করেছেন। হিসেব করে তিনি বলেন, নিজে শ্রম দিতে না পারায় রোপণ থেকে শুরু করে ঘরে তুলে নেওয়া পর্যন্ত প্রতি বিঘায় তার খরচ হবে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা।’
আক্কেলপুর উপজেলার সোনাই মাগুড়া গ্রামের আদর্শ কৃষক আব্দুল জলিল বলেন, ‘এবার ৮ বিঘা জমিতে আলু চাষের প্রস্তুতি নিয়েছি। ইচ্ছে ছিল সবগুলোতেই ব্র্যাকের উচ্চ ফলনশীল ডায়মন্ড জাতের আলু চাষ করার। এ জন্য আমার বীজ দরকার ছিল ৪০ মণ, কিন্তু বীজ পেয়েছি ২০ মণ। বাকি বীজ আমি স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করেছি। নিজস্ব জমিতে নিজে শ্রম দেওয়ায় আলু চাষে আমার কিছুটা খরচ কম হওয়ায় লোকসান খেতে হয় না। তিনি বলেন, আলুর দাম বেশি হওয়ায় কোন জমিই কৃষকরা ফেলে রাখছেন না। সবাই আলু চাষে মনোযোগী হয়েছেন।’
বিজ্ঞাপন
জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার মঞ্জুর রহমান বলেন, ‘জেলায় আলু চাষ বেশি হওয়ায় উন্নত জাতের আলু বীজের বরাদ্দ সবসময় বাড়ানোর চেষ্টা থাকে। বিএডিসি এবার ৪ হাজার ১০০ মেট্রিক টন বীজ সরবরাহ করেছে এ জেলায়। অথচ পাশের জেলা বগুড়ায় সরবরাহ হয়েছে মাত্র আড়াই হাজার মেট্রিক টন। জেলায় বীজের প্রয়োজন ৬০ হাজার মেট্রিক টন। সব কৃষকের চাহিদা উন্নত জাতের আলু বীজের। সেটা তো পূর্ণ করা সম্ভব নয়। কৃষকদের বুঝতে হবে। বীজের চাহিদা পূরণ করতে হলে কৃষকদেরই উদ্যোক্তা হতে হবে। আমরা সেই চেষ্টা করছি।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মুজিবর রহমান বলেন, ‘জেলায় কৃষক পর্যায়ে আলু বীজ এবং সারের কোনো সংকট নেই। অসাধু বীজ ও সার ব্যবসায়ীদের দ্বারা কৃষক যেন প্রতারিত না হয়, সেজন্য কৃষি বিভাগ সবসময় তৎপর। আলু চাষে সার্বিক পরিবেশ ভালো, এজন্যই কৃষকরা আলু চাষে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন।’
প্রতিনিধি/একেবি

