মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চোর-ছিনতাইকারীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

চোর-ছিনতাইকারীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম

চোর-ছিনতাইকারীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। দিন-রাত, যে কোনো সময় নগরী ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে গণপরিবহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং পণ্য পরিবহনকারী গাড়িতে ছিনতাইকারীরা হামলা করছে। এ অবস্থায় পুলিশ টহল বাড়ানোর পাশাপাশি, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছে, তবে পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

নগরীর গণপরিবহনে বসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল, ব্যাগ, ল্যাপটপসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিস ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ রুট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।


বিজ্ঞাপন


চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে চালক ও সহকারীকে জখম করার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আহত হচ্ছেন শত শত মানুষ, যার ফলে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে। উদ্বেগ বেড়েছে পরিবহন চালক ও মালিকদের মধ্যেও।

পণ্য পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানান, সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশ সদস্যদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ছিনতাইকারীদের উৎপাত বেড়ে গেছে। এরা সুযোগ বুঝে চালককে জিম্মি করে বিভিন্ন পণ্য লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, ফলে আমদানি-রফতানিকারকরা বিপাকে পড়ছেন। একই পরিস্থিতি চট্টগ্রাম মহানগরীর সর্বত্র বিরাজ করছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর ১০নং রুটের বাস চালক নাজিম উদ্দিন বলেন, নগরীর এই রুটের মুরাদপুর, ষোলশহর রেলস্টেশন, দুই নম্বর গেইট, জিইসির মোড়, টাইগারপাস, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ, কাস্টমস, ইপিজেড ও পতেঙ্গা এলাকায় বাস দাঁড়ালে জানালা দিয়ে যাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব এলাকায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পলাতক নেতাকর্মীরা ঘাপটি মেরে আছেন, যারা এখন চুরি-ছিনতাই কাজে সক্রিয় রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. ফরিদ মিয়া বলেন, ‘গত শনিবার নগরীর বহদ্দারহাটে মোটরসাইকেলের ওপর হেলমেট রেখে দোকানে কিছু পণ্য কিনে ফেরার পর দেখি, হেলমেটটি নেই।’

একই কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত স্থানীয় একটি পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার গোলাম সরওয়ার। তিনি বলেন, ‘গত কয়েকদিন আগে নগরীর টাইগারপাস আমবাগান এলাকা থেকে আমার মোটরসাইকেলে রাখা হেলমেটটি চুরি হয়ে গেছে।’

সিএমপির বিভিন্ন অপরাধ নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে বেশিরভাগ ছিনতাই মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ঘটে। বিশেষ করে ভোরবেলা চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন, নিউ মার্কেট, গরিবুল্লাহ শাহ, এ কে খান এবং অলঙ্কার বাস টার্মিনালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যাত্রীদের টার্গেট করে ছিনতাইকারীরা। যাত্রীরা যখন বাস ও ট্রেন থেকে নেমে রিকশা, সিএনজি বা পায়ে হেঁটে বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছেন, তখন ছিনতাইকারীরা অন্ধকার বা আবছা অন্ধকারে তাদের টার্গেট করে। এছাড়া দিনের বেলায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের গ্রাহকদেরও টার্গেট করে ছিনতাইকারীরা।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনকারী কাভার্ডভ্যানচালক নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এখন সম্পূর্ণ অনিরাপদ। বিশেষ করে সীতাকুন্ড ও মিরসরাই এলাকায় ছিনতাই বেড়েছে। গাড়ির গতি কমালে ছিনতাইকারীরা গাড়িতে উঠে চুরি করে, আবার অনেক সময় রাস্তার দুপাশে লুকিয়ে থেকে সুযোগ বুঝে হামলা চালায়।’

পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহমেদ বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে ছিনতাই বেড়ে গেছে। গাড়ির কাগজপত্র চুরি করে অর্থ দাবি করা হচ্ছে, চালকদের হয়রানি করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পণ্য পরিবহনের গাড়ি রাস্তায় নামানো মুশকিল হয়ে যাবে।’

তিনি জানান, গত ১১ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য লোড করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়া আরমান ট্রেডার্সের একটি গাড়ি মিরসরাই বাজার এলাকায় এলে কিছু দুষ্কৃতকারী হামলা করে। তারা চালকের মোবাইল, মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে গাড়িটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। চালক ৯৯৯-এ কল দিলে দুষ্কৃতকারীরা চালককে কুপিয়ে জখম করে এবং গাড়ির গ্লাস ভেঙে পালিয়ে যায়।

এর আগে ৬ অক্টোবর দুপুর ১:৩০টার দিকে সীতাকুন্ডের নেমশন ডিপোতে অবস্থানকালে তিনটি গাড়ির (ঢাকা মেট্রো-ট-২০-১৮৫৫, ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-০০১৮, ঢাকা মেট্রো-ট-২০-৭২৫১) ভেতর থেকে গাড়ির ডকুমেন্ট চুরি করা হয়। পরে চালকদের ফোন করে ডকুমেন্ট ফেরত পাওয়ার জন্য ১৫ হাজার টাকা করে মোট ৪৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়।

এছাড়া, গত ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরের ইপিজেড এলাকায় একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ট ১১-৫৬৭৪) থেকে প্লাস্টিক দানা চুরি হয়। ২ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে ১৫ টন (মূল্য প্রায় ২২ লাখ টাকা) ঢেউটিন নিয়ে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেয়া বিসমিল্লাহ ট্রান্সপোর্টের একটি ট্রাক দাউদকান্দি ব্রিজ পার হওয়ার পর ডাকাতদের হাতে আটকিয়ে যায়। ডাকাতরা ট্রাকচালককে বেঁধে ফেলে এবং ট্রাকটি নিয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন গাড়িটি গাজী গ্রুপের টায়ার ফ্যাক্টরির সামনে খালি অবস্থায় পাওয়া যায়।

কুমিল্লা হাইওয়ে সার্কেল ও চট্টগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী পুলিশ সুপার মাসুম সরদার বলেন, ‘রাতে আমাদের টহল পুলিশ থাকে। তবে আমাদের থানাগুলোর ফোর্সের সংকট রয়েছে, গাড়িরও সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও জানান, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও আশপাশের অঞ্চলে ছিনতাইয়ের ঘটনার বিষয়ে আমরা শুনেছি, তবে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি।’

কুমিল্লা হাইওয়ে সার্কেল ও চট্টগ্রাম সার্কেলের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে পণ্যবাহী গাড়ি ছিনতাই নিয়ন্ত্রণ করছে অন্তত ১৭ জন। তাদের মধ্যে চশমা জামাল, ঢাকাইয়া মনির, নোয়াখাইল্যা বেলাল, হারুন, লুলা মনির, পানির ট্যাঙ্কি জাহাঙ্গীর, সোর্স বাবু, লোহা মিজান, পাখি, জামশেদ, ভাঙারি দুলাল, মনোলাল, নবী হোসেন, ইউসুফ, পিচ্চি লোকমান, কোটিপতি বাবু ও তার ভাই বাবুল রয়েছে। এই চক্রের সদস্যরা পণ্যবাহী গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করে, ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে এবং গতি কমিয়ে গাড়িতে উঠে পণ্য চুরি করে। এছাড়া, তারা পণ্য বিক্রি ও অর্থ আদায়ের কাজেও জড়িত।

ss

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা হারানো এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পুলিশের মনোবল ভেঙে যাওয়ায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।’

তবে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার কাজী মুহাম্মদ তারেক আজিজ বলেন, ‘ছিনতাই প্রতিরোধে আমাদের টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। চিহ্নিত ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা বিভিন্ন এলাকায় টহল বাড়িয়েছি এবং বিশেষ অভিযান চালাচ্ছি।’

তিনি আরও জানান, ‘চট্টগ্রামের প্রতিটি থানার ওসিদের এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে এবং ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর