শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

‘দস্যুমুক্ত’ সুন্দরবনে ফের বেড়েছে দস্যুদের উৎপাত

গাজী ফারহাদ, সাতক্ষীরা
প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img
ফাইল ছবি

ছয় বছর আগে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এখন আবারও সুন্দরবনে তৎপর হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। জেলেরা বলছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে পালানো দাগি আসামি এবং ছয় বছর আগে আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা সুন্দরবনে গিয়ে আবারও শুরু করেছে দস্যুতা। সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ জেলে অপহরণের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ জেলেকে উদ্ধার করেছে বনবিভাগ।

জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, মাছ ছিনতাই, চাঁদা আদায়সহ নানা ধরনের অপরাধ ঘটছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। সবশেষ ১২ নভেম্বর রাতে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে বাড়ি ফিরেছেন সুন্দরবনে বনদস্যু মজনু বাহিনীর হাতে অপহৃত দুই জেলে। জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসা জেলে আতাহার হোসেন (৩৫) ও রুহিন সানা যথাক্রমে খুলনার কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের শফিকুল বিশ্বাস ও রহিম সানার ছেলে। একই বনদস্যু দলের সদস্যরা আতাহার ও রুহিনকে মুক্ত করে দেওয়ার সময় আবু বক্কার গাজী নামে অপর এক জেলেকে জিম্মি করেছে বলে জানা গেছে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

সুন্দরবনে আটক ২০ হরিণ শিকারি জেলে

এর আগে, গত ৪ নভেম্বর রাতে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় বনদস্যুর কবল থেকে ১০ জেলেকে উদ্ধার করে বন বিভাগ। উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন- উপজেলার চুনকুড়ি গ্রামের আলিম গাজী, নূরুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, হাফিজুর রহমান, মফিজুর রহমান, মুছাক সানা, শফিকুল গাজী, নজরুল ইসলাম ও রফিকুল মল্লিক। এ সময় রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ হয় দুই পক্ষের মধ্যে। বনদস্যুদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনটি নৌকা, সোলার প্যানেল ও এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে বন বিভাগ।

গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সর্বপ্রথম গত ২০ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টার দিকে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে শফিকুল গাজী (৪৫) নামে এক জেলেকে অপহরণ করে বনদস্যুরা। পরদিন বুধবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল হামিদ লাল্টু। তবে গত ১০ নভেম্বরের অভিযানে অপহরণ শিকার শফিকুল গাজীকে উদ্ধার করে বন বিভাগ।

Sundorban1


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেদের কাছ থেকে জানা যায়, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃতি পশ্চিম সুন্দরবনে আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী নামে বনদস্যুদের নতুন কয়েকটি দল তৎপরতা শুরু করেছে।

সবশেষ ফিরে আসা জেলে আতাহার হোসেন জানান, গত ৮ নভেম্বর সকালে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের হাঁড়িভাঙ্গা নামীয় এলাকা থেকে বনদস্যুরা তাদের অপহরণ করে। এসময় তারা পরিবারের সদস্য এবং মহাজনের নাম্বার ও নাম নেয়। সোমবার মুক্তি পেয়ে মঙ্গলবার রাতে তারা হরিনগর এলাকার চুনকুড়ি খাল দিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসেন। মুক্তিপণের বিষয়ে তাদের মহাজন জানেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ফিরে আসা জেলের মহাজন জানান, অপহরণের পর বনদস্যুরা চার লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। পরবর্তী সময়ে মুক্তিপণের অংক কমিয়ে দুই লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। রোববার (১০ নভেম্বর) বিকাশযোগে দুই লাখ টাকা পরিশোধের পর বনদস্যুরা সোমবার (১১ নভেম্বর) রাতে অন্য একটি জেলে নৌকায় তাদের উঠিয়ে দেয়। মঙ্গলবার রাতে তারা পরিবারের কাছে পৌঁছেছেন।

আরও পড়ুন

নিষেধাজ্ঞা শেষে সুন্দরবনে ফিরছে পর্যটক ও বনজীবীরা

ফিরে আসা জেলেদের দাবি, ২০১৮ সালে র‌্যাব-৮ এর হাতে আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু মজনু আবারও সুন্দরবেন দস্যুতা শুরু করেছেন। তিনটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ সাত/আট সহযোগীকে নিয়ে তিনি আবারও জেলে অপহরণসহ মুক্তিপণ আদায়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন। বিপুল কোম্পানির নৌকাযোগে তিন সপ্তাহ আগে এসব বনদস্যু সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন বলে জানান তারা।

সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের আকবর তরফদারের ছেলে আব্দুল্লাহ তরফদার (৪২) গত ১৪ সেপ্টেম্বর নারীপাচার মামলায় জেলে যান। গত ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙা হলে সেখান থেকে পালিয়ে কৈখালী ইউপির পারাণপুর গ্রামে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নেন। ৬ আগস্ট রাতে টেংরাখালি গ্রামের আরও কয়েকজন মিলে মিরগাং মোড় দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন। বনদস্যুতায় নামা আব্দুল্লাহ বাহিনীর প্রধান আব্দুল্লাহর সঙ্গে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল রয়েছে। তাদের অধিকাংশ কারাগার থেকে পালানো বলে জানা গেছে।

বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।

গত ৪ নভেম্বর বন বিভাগের উদ্ধার সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার জেলেরা জানান, তাদের কয়েক জনকে টগিবগি এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে দস্যুরা। এরপর হাত-মুখ বেঁধে আটকে রাখে। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে এক লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করে। এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠান। পরে একজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি টাকা দিলে অন্যদের ছাড়ার কথা বলে।

জেলেরা জানান, সুন্দরবনে ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল জেলেদের কাছে যা পাচ্ছে সব নিয়ে নিচ্ছে। তারা প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেল সুপার মোহাম্মদ এনায়েত উল্যা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কারাগার থেকে পালানোর ঘটনার পর সদর থানায় ৮৭ জন হাজতি ও কয়েদির নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ জন ফিরে আসে। এখনো ৫৪ জন বাইরে রয়েছে। এর মধ্যে দুই জন রয়েছে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত।’

Dossu

জেল সুপার বলেন, ‘আব্দুল্লাহ তরফদার মানবপাচার মামলায় গত ১৫ জুলাই শ্যামনগর থানার মাধ্যমে কারাগারে আসেন। ৫ আগস্ট রাতে পালিয়ে যান। এখনো কারাগারে আসেননি। তিনি হাজতি ছিলেন।’

র‌্যাব-৬ সাতক্ষীরা ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার মো. জিয়াদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে বনদস্যুদের ব্যাপারে আমি কথা বলেছি। আমরা পুরাতন বনদস্যুদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। পাশাপাশি ‘দস্যুমুক্ত’ সুন্দরবনে কেউ নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইলে কঠোর হাতে দমন করা হবে। জেলেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে র‌্যাব। এ ধরনের কোনো ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান জালাচ্ছি। নতুন করে কেউ আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে আমরা কঠোর হাতে দমন করবো।’

বনবিভাগের কদমতলা ফরেস্ট স্টেশনের এসও সোলায়মান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গত ৩ নভেম্বর সুন্দরবনের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় অভিযান চালানো হলে বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা বন বিভাগের সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে বন বিভাগের সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় প্রতিরোধের মুখে বনদস্যুরা পালিয়ে যায়। ধ্বংস করা হয় বনদস্যুদের একটি আস্তানা।’

আরও পড়ুন

সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ বনায়ন নিয়ে নতুন পরিকল্পনা

বন কর্মকর্তা বলছেন, ‘দীর্ঘদিন সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ বনদস্যুমুক্ত থাকার পর সম্প্রতি আবারও বনদস্যুদের কয়েকটি বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বাহিনীর অত্যাচারে জেলে-বাওয়ালিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে ভারতে বসে এই বনদস্যু গ্রুপটি জেলেদের কাছে মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবি করছে বলে জেলে-বাওয়ালিরা অভিযোগ করেছেন।’

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এ.জে.এড হাছানুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সম্প্রতি বনদস্যুদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে সম্প্রতি বন বিভাগ একটি অভিযান পরিচালনা করে ১০ জেলেকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে অপহরণের কথা শোনা গেলেও আমাদের ভুক্তভোগীর পরিবার তেমন কোনো তথ্য দিচ্ছে না। যে কারণে আমাদের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা সবসময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করছি।’

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন