নেই কোনো রাইড কিংবা দৃশ্যমান প্রাণী, নেই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও। পরিবেশও ভুতুড়ে। তবে রয়েছে কাঠের আলনা, খাট ও সিঙ্গেল ‘বেডরুম’ এবং এটাচ বাথরুম। আনাগোনা হয় তরুণ-তরুণীদের। চলে অনৈতিক নানা কার্যকলাপ। মাত্র ২০ টাকা দিয়ে একবার টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করে অবস্থান করা যায় প্রায় ১০ ঘণ্টা। ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে এমনই এক বিনোদন স্পটের সন্ধান মিলেছে।

বিজ্ঞাপন
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়য়নের চকএনায়েত এলাকায় এই বিনোদন স্পটটি ‘প্রগতি পার্ক’ নামে গড়ে উঠেছে। মূল শহর থেকে ৫১ কিলোমিটার পূর্বদিকে অজপাড়াগায়ে এটির অবস্থান।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে আব্দুল জলিল নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি নিজস্ব ২ একর জমির আমবাগানকে আয়বর্ধক করতে নার্সারি তৈরি করেন। নার্সারি থেকে ফুলবাগান হয়ে পরে সেটি শিশুপার্কে রূপ নেয়। আব্দুল জলিলের মৃত্যুর পর তার ৪ ছেলে জায়গাটিকে ‘মিনি চিড়িয়াখানা’ করে ‘প্রগতি পার্ক’ হিসেবে নামকরণ করেন। দর্শনার্থী হিসেবে এই পার্কে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। এতে সন্দেহ তৈরি হয় স্থানীয়দের।

তারা জানান, অনৈতিক কাজের জন্য ‘প্রগতি পার্ক’ নিরাপদ স্থান। দীর্ঘদিন ধরে আপত্তিকর নানা অসামাজিক কার্যকলাপ হয়ে আসছে। পার্কটি বন্ধের দাবি উঠলেও রহস্যজনক কারণে বন্ধ হয়নি।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় বাজারের এক দোকানি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কাপল থাকে, অনেক আগে থেকেই এরকম চলে। রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে, থাকা যাবে। এটা গ্রাম অঞ্চল তো খরচ বেশি না। দূর থেকে অনেকে আসে, কাজ করে চলে যায়।’

ইন্টারমিডিয়েটের এক শিক্ষার্থী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের বন্ধু-বান্ধবীরাও যায়। এমনি ঢুকলে ২০ টাকা টিকিট। রাতে বেড পাওয়া যায়। খরচ এই ধরেন এক হাজার বা দেড় হাজার টাকা এরকম লাগে। ওখানে তো কিছু নাই, একটা বান্দর (বানর) আর কচ্ছপ আছে।’
রোববার (১০ নভেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে পার্কে অবস্থান করতে দেখা যায়। সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে পার্ক থেকে তারা বেরিয়ে যেতে শুরু করেন। এসময় জীর্ণশীর্ণ টিন শেড কক্ষে বিছানা এলোমেলো অবস্থায় দেখা যায়। এদিন এক ছাত্রীকে নিয়ে পার্কে এসেছিলেন পাবনার ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আসিফ। তার বাসা নাটোরের লালপুরে। সাংবাদিক দেখে মুহূর্তেই তার সঙ্গে থাকা ওই ছাত্রী সটকে পড়েন।

এ সময় কলেজছাত্র আসিফের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ধরেন ও আমার গার্লফ্রেন্ড। ঘুরতে এসেছিলাম। ৫০ টাকা টিকিট কেটে ঢুকেছিলাম। এখন চলে যাচ্ছি। আমাদের কিছু করিয়েন না ভাইয়া।’
তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর পার্কটিতে অসামাজিক কার্যকলাপের ঘটনায় ৬ জন নারীসহ পুলিশ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে বিবাহিত ছিলেন ৬ জন। এছাড়া ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর প্রগতি পার্কে ওই উপজেলার তেঁপুকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। স্কুলছাত্রী ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হলে তার পরিবার ঘটনাটি জানতে পারে। পরে ছাত্রীর নানার করা মামলায় নাটোরের লালপুরের আলাউদ্দিন নামে অভিযুক্ত যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ গতমাসে প্রগতি পার্কে টিকটকাররা মিলনমেলার নামে প্রকাশ্যে অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শন ও অশ্লীল কার্যকলাপে লিপ্ত হন। এলাকার শিশুদের সামনেই তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরাসহ আপত্তিকর অবস্থায় নাচানাচি করেন তারা। ওই অনুষ্ঠানে টাঙ্গাইল জেলা থেকে ‘কালাচাঁন ভাই’ ও তার দল এবং নওগাঁ থেকে ‘কুদ্দুস ভাই’ ও তার নৃত্য দল এসে নাচ পরিবেশন করে। টিকটকারদের ওই অনুষ্ঠানে আপত্তিকর অবস্থায় নাচানাচির একটি ভিডিও ঢাকা মেইলের হাতে এসেছে।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রগতি পার্কের মালিক নাজমুল ইসলাম লিপু ঢাকা মেইলকে বলেন, এখানে কোনো অসামাজিক কার্যকলাপ হয় না। আপত্তিকর নাচানাচির ভিডিও দেখানো হলে প্রথমে ভিডিওটি ওই পার্কের নয় বলে দাবি করেন তিনি। পরে তার ছোটভাই রেজমানুল হক ফিটুকে ডাকেন। ফিটু এসেও ভিডিওটি পার্কের নয় বলে উড়িয়ে দেন। এরপর নিজেকে বিএনপির সমর্থক পরিচয় দিয়ে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মঞ্চে নাচগান হয়েছে, এখানে অনৈতিকের কী দেখলেন? কন্টাকে ভাড়া দিয়েছিলাম, কী করেছে না করেছে, এটা তাদের ব্যাপার।’

এতদিন ধরে অসামাজিক কার্যকলাপ চলার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফিটু বলেন, ‘পুলিশ আসত, তেল খরচ দিতাম। থানা থেকেই অফার দেয় অনৈতিক কাজ চালাতে। আমরাই বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম। বিগত সময়ের ইউএনওরা বন্ধ করতে দেয়নি। হুমায়ুন কবির গোলাম রাব্বানি এরা ছিল।’

পার্কের ভেতর সিঙ্গেল সিটের ঘর, কাঠের খাট ও আলনা থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাজমুল ইসলাম লিপু বলেন, ‘এখানে আমি মাঝেমধ্যে থাকি। বার্থডে কেক তৈরি হত এখানে। কেক তৈরির মেশিন ছিল ঘরে। আরও কিছু জিনিসপত্র রাখা আছে। তবে পার্ক আমরা রাখবো না। লোকজন সে রকম আসে না, লাভ হচ্ছে না। গরুর খামার করে দেব।’ প্রগতি পার্কে স্কুলছাত্রী ধর্ষণ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে ওই সময় তারা দুই ভাইয়ের কেউই দায়িত্বে ছিলেন না বলে দাবি করেন।

এসব ব্যাপারে বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাম্মী আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি ৩০ অক্টোবর যোগদান করেছি। তবে আমি খোঁজ নিচ্ছি। এ ধরণের কোনোকিছু ঘটলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
প্রতিনিধি/ এজে

