চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চারপাশে দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধুই হাসপাতাল, ক্লিনিক আর প্যাথলজিকেল ল্যাব। নগরীর আবাসিক এলাকাগুলোতেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজে উঠেছে এমন হাসপাতাল-ক্লিনিক ও প্যাথলজি। যার অধিকাংশই অনুমোদনহীন।
এসব হাসপাতালে কান পাতলে প্রতিদিনই শোনা যায় স্বজন হারানোর কান্না। হয় ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু, নয় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, সঙ্গে বিল পরিশোধ করতে না পারার আহাজারি। এমনকি প্যাথলজিকেল ল্যাবগুলোতে রোগ নির্ণয়ে ভুল রিপোর্ট নিয়ে ঝগড়াঝাটি লেগেই আছে নিত্যদিন।
বিজ্ঞাপন
এসব নিয়ে স্বাস্থ্যবিভাগে ক্ষতিগ্রস্ত রোগী বা স্বজনদের একাধিক অভিযোগ জমা হলেও কোনো সময়ই তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেকে প্রিয়জনদের হারিয়ে আদালতে মামলা করলেও তেমন কোনো আইনি ব্যবস্থা তেমন চোখে পড়েনি। বরং সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চিকিৎসার নামে টাকা হাতানোর মিশন চালিয়ে যাচ্ছে এসব হাসপাতাল-ক্লিনিক ও প্যাথলজির মালিকরা।
সম্প্রতি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সকল অবৈধ, অনুমোদনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক ও প্যাথলজি বন্ধের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির নির্দেশনা জারি করেছেন। এরপরও পরও সচল রয়েছে এসব হাসপাতাল-ক্লিনিক ও প্যাথলজি।
তবে এই নির্দেশনায় কিছুটা হলেও টনক নড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের। শনিবার (২৮ মে) সকালেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ৬টি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও প্যাথলজি ল্যাবে অভিযান চালানো হয়। আর অভিযানে নেমেই বিপুল অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন বলে জানান চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘নির্দেশনা পাওয়ার পর আমরা অনুমোদিত হাসপাতাল-ক্লিনিক ও প্যাথলজির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। শনিবার সকাল থেকে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন সিএসটিসি হাসপাতাল, চট্টেশ্বরী রোডের কসমোপলিটন হাসপাতাল, মনসুরাবাদের পপুলার মেডিকেল সেন্টার, ওয়াসা মোড়ের নিরুপনী ল্যাব ও ডায়গনস্টিক, ট্রিটমেন্ট হাসপাতাল, পলি হাসপাতালে অভিযান চালায়। সেখানে এক ল্যাব ও হাসপাতালে মূল্য তালিকা দেখাতে পারেনি। তিনটি ল্যাবে কোনো নিবন্ধনের কাগজপত্র নেই। বাকি তিনটিতে কাগজপত্র থাকলেও মারাত্নক পরিবেশ ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে এর মধ্যে দুটি ল্যাব ও দুটি ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বিভাগে ২২৩২টি বেসরকারি হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। অথচ লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছে ১ হাজার ৪০২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে চট্টগ্রামে অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চার শতাধিক। এছাড়া ২০২০ সালের আগস্টে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ লাইসেন্স না থাকায় চট্টগ্রামের ৩৮ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
শুধু লাইসেন্স বা পরিবেশগত ছাড়পত্র নয়, অনুমোদন থাকা অনেক হাসপাতালের চিকিৎসক নার্সদের নিয়োগপত্রও নেই। এমনকি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তালিকা না থাকা, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের লাইসেন্স, প্যাথলজিস্ট, রিপোর্ট প্রদানকারী চিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টেরও তালিকা নেই অনেক হাসপাতালে। যার কারণে ভুল চিকিৎসায় এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ভুল রিপোর্টও আসছে প্যাথলজিগুলোতে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ ফজলে রাব্বি জানান, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ল্যাবগুলোতে অনিয়মের কথা উঠে আসে বিভিন্ন সময়। তবে এসব অভিযোগের কোনো প্রতিকার নেই। অনেক ক্ষেত্রে লাইসেন্স নবায়ন না করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, নিয়মবহির্ভুতভাবে শয্যা রাখা, কিছু প্রতিষ্ঠানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সের নিয়োগপত্র না থাকা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তালিকা ও ক্লিনার নিয়োগের তথ্য না থাকা, রোগ নির্ণয়ের মূল্য তালিকা দৃশ্যমান করে না রাখা, রিপোর্ট প্রদানকারী চিকিৎসক-প্যাথলজিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্টের তথ্য না থাকা, হাসপাতালে কোনো ব্লাড ব্যাংক এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অনুমোদনহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশনা এসেছে। চট্টগ্রাম বিভাগের সব সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। শুধু অনুমোদনহীন নয়, অনুমোদন আছে এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও আমরা অভিযান পরিচালনা করব। সব নিয়ম মেনে চলছে কিনা দেখব।
উল্লেখ্য, অনুমোদনহীন হাসপাতাল আর কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে না জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির নির্দেশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে-আগামি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ করতে হবে অবশ্যই। অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে এ কার্যক্রম চলমান থাকবে। এই কার্যক্রমে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন গ্রহণ করেও নবায়ন করেননি, তাদের নিবন্ধন নবায়নের জন্য সময়সীমা প্রদান করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নবায়ন গ্রহণ না করলে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে অপারেশনের সময় এনেস্থেসিয়া প্রদান, ওটি অ্যাসিস্ট করার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত চিকিৎসক ছাড়া অন্যদের রাখা হলে সেসব প্রতিষ্ঠান ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন নিবন্ধনের আবেদন করেছে তাদের লাইসেন্স দেওয়ার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হবে। লাইসেন্সপ্রাপ্তির আগে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাতে পারবে না বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
টিবি

