গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কৃষক আব্দুল মতিন মিয়া (৪২)। তিনি বস্তায় করে ২৫ কেজি বেগুন এনেছিলেন বাজারে। পাইকারিতে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা দরে তা বিক্রি করেন কয়েক জন কাঁচামাল ব্যাবসায়ীর কাছে। পরে তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত হাত বদলে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়ে।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কি আর বলি ভাই! দেশটা চোরের দেশ হয়ে গেছে। কষ্ট করে আবাদ করি। বিক্রি করতে এলে দাম কম। কিনতে গেলে বেশি। কে দেখবে, আর কাকে বলি এসব দুঃখের কথা।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
আব্দুল মতিন মিয়া বলেন, ২৫ শতাংশ জমিতে বেগুন আবাদ করেছি। নিজের পেটের বাচ্চাদের চেয়েও বেশি যত্ন নিতে হয়। কখন যে কি হয়, সেই ভয়ে থাকতে হয় সব সময়। কখনও সার, কখনও কীটনাশক। জৈবসার প্রচুর ব্যাবহার করতে হয়। গরু-ছাগলের ভয়তো আছেই। এতো যত্নের পরেও বেগুনের আবাদ ঠিক রাখতে পারিনি বৃষ্টির কারণে। সব শেষ এবার। সপ্তাহে যেখানে প্রায় ৫ মণ বেগুন ওঠার কথা, সেখানে সপ্তাহে এক মণ বেগুনও উঠছে না। নয়দিন পর আজ বেগুন উঠেছে মাত্র ২৫ কেজি। কোনোভাবেই হিসাব মিলছে না। সামনের দিনে খরা না গেলে লসের পরিমাণটা আরও বাড়বে বলেও জানান তিনি।
সবজির চড়া দামের কারণ খুঁজতে সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার কাঁচা বাজারে যাওয়া হয়। এ সময় কথা হয় কৃষক, খুচরা বিক্রেতা, পাইকারি বিক্রতা ও ভোক্তাদের সঙ্গে। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত হাত বদলে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়ে বিষয়টি এসময় পরিষ্কার হয়ে উঠে।
পাইকারি বিক্রেতা ছামিউল ইসলাম বলেন, আমি দিনাজপুরের ফুলবাড়ি বিরামপুর থেকে ফুল কপি এনেছি। খুচরা ব্যাবসায়ীদের কাছে পাইকারিতে প্রতি কেজি ১০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। এখন তারা কতো কেজি বিক্রি করবেন সেটা জানি না।
গোলাম রব্বানী (৬১) নামের এক ভোক্তা জানান, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য। তার বাড়ি পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। তিনি বলেন, বেগুনের কেজি ৭৫ টাকা। সে কারণে বেশি নিতে পারিনি। বেগুন, ঝিংগে ও ঢেঁড়স সব মিলিয়ে ৩৫ টাকার সবজি নিলাম। আর ধনেপাতা নিলাম ২৫ গ্রাম ৮ টাকা দিয়ে। আজকের কাঁচা বাজার শেষ। আরও অন্য বাজার আছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এ সেনা সদস্য বলেন, কি করব ভাই, সব জিনিসপত্রের যে দাম। হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে। জীবন তো বাঁচাতে হবে।
আরেক ক্রেতা জাহেদা বলেন, আধা কেজি বেগুন কিনলাম ৩৫ টাকা দিয়ে। মরিচ ৫০ গ্রাম ২৫ টাকা দিয়ে। যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম এতেই সব শেষ।
এ বিষয়ে খুচরা সবজি বিক্রেতা সিরাজুল ইসলাম বেগুন ৭৫ ও ফুল কপি ১২০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি করছেন বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, দোকান চালাতে অনেক খরচ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পলিথিন লাগে দুই থেকে আড়াইশো টাকা। বাপ-বেটার পকেট খরচ দুই থেকে ৩০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল ২০ টাকা, ডিউটি ৫ টাকা। এছাড়াও অনেক খরচ হয়। সব মিলিয়ে দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ আমাদের। দিন শেষে দেখা যায় কোনোদিন খালি পকেটেও যেতে হয় বাড়িতে।
তবে তিনি ৫০ টাকা কেজি দরে বেগুন ক্রয় করতে পারেননি। কিনেছেন ৬৫ টাকা কেজিতে। কেজিতে ৭-৮ টাকা লাভে সবজি বিক্রি করেন বলেও জানান এ ব্যাবসায়ী।
পৌর বাজারে অনেক ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা যেখানে কেনেন সেখানেই বিক্রি করেন। যাতায়াত ভাড়াসহ বাড়তি কোনো খরচ নেই ব্যাবসায়ীদের। তারপরও এতো বেশি লাভে বিক্রি করেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। করার কিছুই নেই আমাদের। আমরা অসহায়। এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন ভুক্তভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজির হোসেন বলেন, দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ব্যাপক তৎপর আছে। ইতোমধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও কৃষি বিপণন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার সভা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের জেলা কর্মকর্তা মেজবাহুল বলেন, গত বৃহস্পতিবার জেলা ডিসি অফিসে সভা হয়েছে। সেখানে ডিসি স্যার, সব উপজেলার ইউএনও, কৃষি বিপণন কর্মকর্তা, গণমাধ্যম কর্মী ও আমরাসহ অনেকে উপস্থিত ছিলাম। কৃষকের কাছ থেকে কতো টাকায় সবজি ক্রয় করল তার মেমো রাখতে হবে। এরকম নানা পদক্ষেপ গৃহীত হয় ওই মিটিংয়ে। এটি বাস্তবায়ন হলেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে বিশ্বাস তার।
প্রতিনিধি/এসএস
