কখনও ভাঙন, কখনও গর্জন, নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন শত শত একরের ফসলি জমি ও আশ্রয়স্থল। ভাঙন থেমে নেই। দুপুর-সন্ধ্যা-রাত নেই, নদী ভাঙন তাড়িয়ে বেড়ায় নদীপাড়ের মানুষকে। নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর অবকাশও নেই। রাত জেগে পাহারায় থাকতে হয়, যদি ভাঙনের ভয়াল থাবায় ভিটেমাটি সব কেড়ে নেয়। কিছুতেই যেন কাটছে না এই আতঙ্ক।
এমনই ঘটনা ঘটছে মুছাপুরের রেগুলেটর ভাঙনের পর নদীপাড়ের মানুষদের। তেমনি একজন বিবিয়া খাতুন। বয়স ৫৬ বছর। স্বামী হারিয়েছেন কয়েক বছর আগে। এক ছেলে থাকলেও যোগাযোগ নেই অনেকদিন ধরে। ছেলের সংসার বেড়ে যাওয়ায় আর নিয়মিত খোঁজ নেন না তার। তাই ছোট্ট একটা ঘরেই এতোদিন বসবাস করে আসছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
মুছাপুর রেগুলেটরটি ভাঙনের আগে নির্ভয়ে রাত কাটিয়েছিলেন বিবিয়া খাতুন। কিন্তু রেগুলেটরটি ভাঙনের পর থেকে তীব্র ভাঙনে তার ছোট্ট বসত ভিটায় মাথা গোঁজানোর শেষ সম্বল টুকুও তলিয়ে যায় নদী গর্ভে।
নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা বিবিয়া খাতুন। চোখের জ্বল ছাড়া যে তার কিছুই নাই। সব হারিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই চান তিনি। আর দু’বেলা দু’মুঠো ভাত, আর যে চাওয়ার কিছু নেই তার।
এর আগে, আরও একবার নদী ভাঙনে হারিয়ে যায় তার ঘর। এরপর হারায় স্বামীকে। স্বামীকে হারিয়ে আশ্রয় নেন মুসাপুরে ক্লোজার রেগুলেটরটি পাশে নদী ঘেঁষা মুছাপুর গ্রামে।
একই অবস্থায় সকিনা খাতুনের নদীগর্ভে সব হারিয়ে স্বামী, ছয় ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
এদিকে স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী মো. নুরুদ্দিন জানান, আমার কৃষি জমিও মাছের ঘেরের কিছু অংশ নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। অতি দ্রুত বাঁধ না করা হলে আমিসহ এখানের শত শত একর কৃষি জমি ও মাছের ঘের গুলো নদীর ভাঙনে তলিয়ে যেতে পারে।
ভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হঠাৎ মুছাপুর ক্লোজার রেগুলেটরি ভেঙ্গে যাওয়ায় কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা মুছাপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় দেড় কিলোমিটারের অধিক এলাকা জুড়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। দিন আর রাতের ব্যবধান নেই এখানে থেমে থেমে ভাঙছে নদীর পাড়। গত কয়েকদিন ধরে জনতা বাজার ও মুসাপুর দুইটি গ্রামে অন্তত পঞ্চাশের অধিক ঘর অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত নদীগর্ভে একশোর অধিক ঘর-বাড়ি ছাড়াও তলিয়ে গেছে কয়েক একর ফসলি জমি, মাছের ঘের, গাছপালা ও অন্যান্য স্থাপনা। নিজেদের সব হারিয়ে কোনো মতে জীবন চলছে ঝুপড়ি ঘরে, রাস্তার দ্বারে, অন্যের আশ্রয়ে, ব্লকের ওপর, নয়তো ভাড়া করা জায়গায়। ভাঙনের কারণে এখানকার শত শত পরিবার এখন বিচ্ছিন্ন।
দেখা যায়, যেভাবে ভাঙতে শুরু করেছে এরই মধ্যে মুছাপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জনতা বাজারের প্রায় আংশিক বিলীন হয়ে গেছে নদী গর্ভে। হুমকির মুখে রয়েছে চারটি ইউনিয়ন চরপার্বতী, চরহাজারী, মুছাপুর ও চর দরবেশ। দ্রুত ভাঙন রোধে ব্যবস্থা না নিলে কয়েকটি গ্রাম ও শত শত বসতভিটা তলিয়ে যেতে পারে নদীগর্ভে। আবার অনেকে খাওয়া-দাওয়া না করে ঘর সরাতে ব্যস্ত ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ। সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে কৃষি জমিতে পানির জন্য বিডিএস এর তৈরি সোলার প্যানেলগুলো। এদিকে রেগুলেটরটি ভাঙনের কারণে এলাকায় ভাঙন রোধে এখনও কোনো কাজ শুরু করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
উল্লেখ্য: নোয়াখালীতে টানা বৃষ্টি ও উজানের পানিতে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে জেলার ৮টি উপজেলার ৮৭টি ইউনিয়নের ২১ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ মানুষ। পানিবন্দি মানুষ গুলোর কথা বিবেচনা করে ২৫ আগস্ট নোয়াখালী মুছাপুর ইউনিয়নের রেগুলেটরের ২৩টি গেট খুলে দেওয়া হয়। খুলে দেওয়া তিনদিন পরেই ভেঙে যায় মুসাপুর ক্লোজার এই রেগুলেটরটি। রেগুলেটরটি ভাঙনের পরেই তীব্র ভাঙন দেখা দেয় ক্লোজার চারপাশের শত শত বসত বাড়ি, কৃষি জমি, মাছের ঘের ও স্থাপনা। হুমকির মুখে পড়ে কয়েকটি গ্রাম ও ইউনিয়ন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে অনেক কর্মকর্তাগণ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। স্থানীয়দের দাবির আলোকে একটি ব্লক তৈরি করা হবে। রেগুলেটরের বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রতিনিধি/ এজে