বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

চট্টগ্রামে বাড়ছে পাহাড় ধসের শঙ্কা, সমাধানে নেই স্থায়ী উদ্যোগ

এম আই খলিল
প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২২, ০৭:২৪ এএম

শেয়ার করুন:

চট্টগ্রামে বাড়ছে পাহাড় ধসের শঙ্কা, সমাধানে নেই স্থায়ী উদ্যোগ

প্রতিবছরের মতো আসন্ন বর্ষা মৌসুমেও পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ছে চট্টগ্রামে। ঘটতে পারে প্রাণহানি। যা আঁচ করতে পারছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও। যুগ যুগ ধরে এই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠলেও স্থায়ী সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই।

বরাবরের মতোই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে প্রশাসন। এমন দাবি চট্টগ্রামের পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহানের।


বিজ্ঞাপন


তিনি জানান, চট্টগ্রামে প্রতিবছর কোনো না কোনো জায়গায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। ঘটে প্রাণহানিও। গত ১৩ বছরে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। ফলে এবারও আসন্ন বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের শঙ্কা বাড়ছে। কারণ আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে এবার অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। যা জেনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বরাবরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলোকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগরে ৬৫ পাহাড়ের মধ্যে ৩৪ পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এরমধ্যে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি।

শরীফ চৌহান জানান, চট্টগ্রাম নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছেন কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। পুরো জেলায় পাহাড়ে বসবাসকারীর সংখ্যা এক লাখের ওপরে। এ বছরও যদি বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয় তাহলে পাহাড়ধস হতে পারে। প্রাণহানিও ঘটতে পারে। এ সমস্য সমাধানে ২০০৭ সালে টেকনিক্যাল কমিটি যে ৩৭ দফা সুপারিশ করেছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ ৩৪ পাহাড় চিহ্নিত:


বিজ্ঞাপন


চট্টগ্রাম মহানগরে ৬৫ পাহাড়ের মধ্যে ৩৪ পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এরমধ্যে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, এসব পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে বসতিগুলো থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।

তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান সামিনা বানু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা সংযোগ না দিলেও ওরা চুরি করে বিদ্যুৎ নেয়। অভিযান চালিয়ে অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্ন করলেও ফের সংযোগ দেয়। ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীরা যদি অবৈধভাবে মিটার ও বিদ্যুতের সংযোগ পেয়ে থাকেন তাহলে দ্রুতই সেগুলো বিচ্ছিন্ন করা হবে।’

ctg

ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের কারণ:

নগরীর পরিবেশ অধিদফতর-সংলগ্ন সিটি করপোরেশন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে বসবাস করছেন লিটন মজুমদার। তিনি বলেন, ‘স্বল্প বেতনে চাকরি করি। বাসা ভাড়া কম, তাই এখানে থাকি। ২০০৪ সাল থেকে বসবাস করছি। এরমধ্যে ২০১০ সালে একবার পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে।’

পরিমল নামের একজন পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে থাকেন বায়েজিদ থেকে সীতাকুণ্ডে যাওয়া সিডিএ লিংক রোডের পাশের পাহাড়ে। তিনি বলেন, ‘মাসে যা আয় করি, এখানে থাকা ছাড়া তো উপায় নেই। ধস হলে বিপদ হবে জেনেও এখানে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে চলে যাব।’

মতিঝর্ণার টাংকির পাহাড়ে নিজেই ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তোলেন জোছনা বেগম। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই ভয়ে থাকি। যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করে না। এ কারণে এখানে থাকা।’

একইভাবে বাটালি হিলের বাসিন্দা মায়া আক্তার বলেন, ‘পুনর্বাসনের জন্য প্রশাসন থেকে আমাদের তালিকা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঝুঁকি নিয়েও আমাদের এখানে বসবাস করতে হচ্ছে।’

বসবাসকারী লোকজনের অভিযোগ, পাহাড়ের পাদদেশে ঘর নির্মাণের পেছনে রয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারাই পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করে নিম্নআয়ের লোকজনকে কম ভাড়ার কথা বলে বসবাসের প্ররোচনা দেন। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। শুধু বর্ষা আসলেই বসতিদের উচ্ছেদ করে।

বর্ষা এলে যা হয় পাহাড়গুলোতে:

বর্ষা আসলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পাহাড় থেকে বসতিদের উচ্ছেদ করতে উঠে-পড়ে লাগে। এ সময় অতিবৃষ্টি বা ঘুর্ণিঝড়ের সংকেত পেলে মাইকিং করে বসতিদের সরিয়ে নেওয়ার নামে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বসতিরা এ সময় নিরুপায় হয়ে আত্নীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে যায়।

ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টি কমে আসলে আবার ফিরে আসে। অথচ বসতিদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। এই সমস্যা সমাধানে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে ৩৭ দফা পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। 

সচেতন নাগরিক কমিটি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ও নগর পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার মজুমদার এ বিষয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি চিহ্নিত করে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন করতে দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এগুলো কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।

এছাড়া যেসব প্রভাবশালী পাহাড় দখল করে ঘর তৈরি করে নিম্নআয়ের লোকজনকে ঝুঁকিতে থাকার প্ররোচনা দিচ্ছে, তাদেরও চিহ্নিত করা জরুরি। সেই সঙ্গে পাহাড়গুলোর সীমানা নির্ধারণ, সংরক্ষণ, পাহাড় ইজারা, দখল বন্ধ ও বনায়নের কথা বলা হয়েছিল। সেটাও করা হয়নি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে প্রশাসন বারবার অস্থায়ী উদ্যোগ নেয়। এর ফলে দিন দিন পাহাড় কেটে ও পাদদেশে ঘর নির্মাণ বাড়ছে।

পাহাড় ধসের মূল কারণ পাহাড় কাটা। চট্টগ্রামে এক শ্রেণির চিহ্নিত ভূমিদস্যু পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। যারা পাহাড় দখল করে স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে ভাড়া আদায় করে। তারা বিভিন্ন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কোন ব্যবস্থা নেয় না। নিলেও দায়সারা। 

পাহাড় ধসের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো:

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামের কোথাও না কোথাও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বৃষ্টির সময় নগরের বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড়ধসে তিনজন নিহত হয়। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে মা-মেয়ে মারা যায়। অথচ এ দুটি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ছিল না। 

ctg

পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়সারা ভূমিকা:

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী জানান, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালি মাটি বেশি। ফলে মাঝারি বৃষ্টিপাত হলেও পাহাড়ধস ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

আর এই পাহাড় ধসের মূল কারণ পাহাড় কাটা। চট্টগ্রামে এক শ্রেণির চিহ্নিত ভূমিদস্যু পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। যারা পাহাড় দখল করে স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে ভাড়া আদায় করে। তারা বিভিন্ন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কোন ব্যবস্থা নেয় না। নিলেও দায়সারা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী ঢাকা মেইলকে জানান, পাহাড় কাটা রোধে নিয়মিত মামলা করা হয়। পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়। ২০২১ সালেও চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় কাটার দায়ে ৪৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি রয়েছেন। কিন্তু এসব করেও পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ ঠেকানো যাচ্ছে না। 

জেলা প্রশাসকের বক্তব্য:

পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান ঢাকা মেইলকে জানান, পাহাড়ে অবৈধ দখলদার ও ভূমিদস্যু কেউ থাকলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে। যারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করছেন, বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে এমন স্থানে বসবাসকারীদের সরিয়ে আনা হবে। এ বছর কোনো প্রাণহানির ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

আইকে/টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর