কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার মঙ্গলবাড়িয়া গ্রাম এখন মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে লিচু গ্রাম নামে। সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্রামটির বিভিন্ন রাস্তার দুই পাশ ও বাড়ির আঙ্গিনা লিচু গাছে ছেয়ে গেছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে শুধু লিচু গাছ আর লিচু গাছ। এই গাছের কারণেই বদলে গেছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের নাম।
কথিত রয়েছে, প্রায় দুইশ’ বছর আগে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার মঙ্গলবাড়িয়া নামক গ্রামে মো. হাশিম মুন্সি নামে এক ব্যক্তি চীন থেকে একটি লিচুর চারা এনে তার বাড়ি উঠানে রোপণ করেন। সেখান থেকেই ওই লিচুর জাত ধীরে ধীরে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে।
মৌসুম এলেই এখন গাছে গাছে দুলতে থাকা লিচুর বাহারি রঙে এ গ্রামের চেহারাও যেন রঙিন হয়ে ওঠে। গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে সবুজ পাতা ভেদ করে লাল টকটকে লিচু আর লিচু। স্বাদ ও গন্ধে অনন্য এ লিচুর খ্যাতিও অনেক। লিচু কিনতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শতশত মানুষ ভিড় জমান এ গ্রামে। জেলার সকল শ্রেণির মানুষের আগ্রহের স্থান এখন মঙ্গলবাড়িয়া। সকাল থেকে রাত অবধি দর্শনার্থীদের পাদচারণায় মুখরিত হয় এ গ্রাম। এ মৌসুমে বেড়াতে আসেন দূরের আত্মীয়-স্বজনরাও। সময় পেলেই প্রতিদিন বন্ধু-বান্ধবরা মিলে আসর জমান লিচু চক্রের।
বিজ্ঞাপন
এ গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে লিচু। লিচুতেই বদলে যাচ্ছে এ গ্রামের কৃষকের জীবন যাত্রা। ভাগ্য বদলেছে দরিদ্র কৃষকেরও। কম খরচে অধিক আয়ের ফলে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে লিচু চাষে। বাড়ির উঠোন ছাড়াও ক্ষেতে করা হচ্ছে লিচু বাগান। এতে স্থানীয় কৃষকেরা ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন।
মাহতাব উদ্দিন নামে এক লিচু চাষি ঢাকা মেইলকে জানান, এবার তার ৭০টির মতো লিচুগাছ রয়েছে। সবকটি গাছেই প্রচুর লিচু ধরেছে, এগুলো বিক্রি করে তিনি প্রায় লক্ষাধিক টাকা আয় করবেন বলেও আশাবাদী।
মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের শিক্ষিত তরুণ কৃষক ছফির উদ্দিন বলেন, লিচু চাষে গ্রামের মানুষের ভাগ্য বদল হয়েছে। তাই গ্রামের প্রায় বেশিরভাগ মানুষই এখন লিচু চাষে মনোযোগী হয়েছেন। তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়মিত তদারকি করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, যদি কৃষি কর্মকর্তারা গ্রামে এসে চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দেন তবে আগামীতে লিচুর আরও ফলন ভালো হবে বলে আশাবাদী।
কথা হয় ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে লিচু কিনতে আসা আসাদ নামে একজনের সঙ্গে। আসাদ জানান, তিনি পেপার-পত্রিকা, ফেসবুকে এ লিচুর কথা শুনে তিন বন্ধুকে নিয়ে লিচু কিনতে এসেছেন। লিচুর স্বাদ গ্রহণ করে তিনি অভিভূত হয়েছেন বলেও জানান।
একটি লিচু বাগানে ভেতরে গিয়ে দেখা মিললো ১৫-২০ জন যুবকের সঙ্গে। তারা জটলা করে বসে লিচু খাচ্ছেন। কথা বলে জানা যায়, তারা স্থানীয় একটি ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে লিচু চক্রের আয়োজন করেছেন। হৃদয় হোসেন নামের একজন বলেন, মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু পাকুন্দিয়াকে দেশ-বিদেশে পরিচয় করিয়েছে। এ লিচুর সুনাম দেশ-বিদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি বছরে লিচুর মৌসুম এলেই আমরা এখানে লিচু চক্রের আয়োজন করে থাকি।
প্রায় কয়েক দশক ধরে লিচুর ব্যবসা করেন তাজুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে তিনি আমাদের জানান, তিনি প্রতিবছরই লিচুর ব্যবসা করেন। তিনি এবার লিচু কাঁচা থাকা অবস্থায় প্রায় ৫০টি গাছ কিনেছেন। প্রতি রাতেই তিনি লিচু গাছগুলোকে পাহারা দেন। এবার তিনি লিচুর ব্যবসা করে ভালো লাভবান হবেন বলেও জানান।
জানা যায়, লিচুর সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার বসে স্থানীয় পুলেরঘাট বাজারে, সেখানে ব্যবসায়ীরা পাইকারি মূল্যে লিচু বিক্রি করে থাকেন। সেখান থেকে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও গাছ থেকে লিচু নামানোর সময়ও খুচরা বিক্রি হয়ে যায়। একশ’ লিচু চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকায় বিক্রি হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে ছোট-বড় প্রায় ১৫ হাজার লিচু গাছ রয়েছে। এবার লিচুর ফলন ভালো হয়েছে। প্রায় ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে ধারণা করছেন তিনি। আগামীতে পুরো জেলায় এ জাতের লিচু আবাদের উদ্যোগ নেবেন বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
বিজ্ঞাপন
প্রতিনিধি/এএ